সম্পাদকীয় ২

অবান্তর কথা

কর্তব্য পালনকে বিলম্বিত করিবার নানাবিধ উপায় আছে। তাহার একটি হইল, অযথা ধোঁয়াশা আমদানি করিয়া কর্মপ্রক্রিয়াটি গুলাইয়া দেওয়া। কেন্দ্রীয় সরকার সেই পদ্ধতি লইয়া শীর্ষ আদালতের ধমক খাইল বটে, তবে এই সুযোগে দুই বৎসর পার করিয়া দিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০০:২৯
Share:

কর্তব্য পালনকে বিলম্বিত করিবার নানাবিধ উপায় আছে। তাহার একটি হইল, অযথা ধোঁয়াশা আমদানি করিয়া কর্মপ্রক্রিয়াটি গুলাইয়া দেওয়া। কেন্দ্রীয় সরকার সেই পদ্ধতি লইয়া শীর্ষ আদালতের ধমক খাইল বটে, তবে এই সুযোগে দুই বৎসর পার করিয়া দিল। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বর্গটিকে অনগ্রসর শ্রেণি হিসাবে চিহ্নিত করিয়া তাহাদের শিক্ষা ও সরকারি চাকুরিতে সংরক্ষণের আওতায় আনিবার পক্ষে রায় দিয়াছিল। বিচারপতি কে এস রাধাকৃষ্ণন ও বিচারপতি এ কে সিক্রির সেই রায় পড়িয়া দেখিলে আদালত ট্রান্সজেন্ডার বলিতে কাহাদের বুঝাইতেছে, সেই বিষয়ে অস্পষ্টতার কোনও অবকাশই থাকে না। আদালতের নির্দেশ যে রূপান্তরকামী ও হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য প্রযুক্ত, সে কথা রায়ের দশম ও একাদশ পৃষ্ঠায় গোটা গোটা করিয়া বলা আছে। লিঙ্গ পরিচয় আর যৌন মনোভঙ্গি যে এক বস্তু নহে, তাহাও ষোড়শ হইতে ঊনবিংশ পৃষ্ঠায় সবিস্তার আলোচিত হইয়াছে। তাহার পরেও সমকামী এবং উভকামীরা ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীভুক্ত হইবে কি না, তাহা লইয়া সরকার কেন যে ঘোর দুশ্চিন্তায় পড়িল, দেবা ন জানন্তি। ক্ষমতায় আসিয়াই নূতন সরকার এই বিষয়ে ‘সংশয় দূর করিবার জন্য’ পুনরায় আদালতের দ্বারস্থ হয়। দুই বৎসর পরে শীর্ষ আদালত ধমক দিয়া বলিল, ইহা নিতান্তই অবান্তর প্রশ্ন। রায় পুনর্বিবেচনা বা অতিরিক্ত ব্যাখ্যার কোনও প্রয়োজন নাই।

Advertisement

কেন্দ্রীয় সরকার সত্যই শীর্ষ আদালতের বক্তব্যের মর্মোদ্ধার করিতে পারে নাই, এমন কথা ভাবা কঠিন। কিন্তু আদালতের নির্দেশ দ্রুত কার্যকর করিতে হইলে নড়িয়া বসিতে হইবে, কাঠখড় পুড়াইতে হইবে। ইত্যবসরে আইনি প্রশ্ন তুলিয়া মামলাটি ফের আদালতে চালান করিয়া দিলে হাতে বেশ খানিকটা সময় মিলিবে। কিন্তু যে দেশে প্রান্তিক যৌনতা বিষয়ে পাহাড়প্রমাণ অজ্ঞতা, অশিক্ষা, ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার এবং সামাজিক অবমাননার রাজত্ব, তথায় সরকারও যদি সময় কিনিবার অছিলায় সেই অজ্ঞতা এবং ভ্রান্ত ধারণায় ইন্ধন জোগায়, তাহা অতি উদ্বেগের কথা। সমকামীরাও ট্রান্সজেন্ডার কি না, এমন বালখিল্য প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া সরকার সেই অবিমৃশ্যকারিতারই পরিচয় দিয়াছে। জনমানসের গরিষ্ঠ অংশে যে ভাবে সমকামী/রূপান্তরকামী একাকার হইয়া যায়, যে ভাবে হিজড়াকে অবমানবের পর্যায়ে নামাইয়া আনা হয়, প্রান্তিক যৌনতাকে অসুখ বলিয়া গণ্য করা হয়, সরকার যেন কতকটা তাহারই প্রতিনিধিত্ব করিয়া বসিয়াছে।

ট্রান্সজেন্ডার শব্দটিই বলিয়া দিতেছে, ইহা লিঙ্গপরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি ও অধিকার আদায়ের সঙ্গে জড়িত। রূপান্তরকামী (পুরুষদেহে নারীমন বা নারীদেহে পুরুষমনের ধারক) এবং হিজড়া বা বৃহন্নলা (দৈহিক ভাবেই পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী)— এই দুই বর্গই সারা বিশ্বে ট্রান্সজেন্ডার বলিয়া মান্য। সমকামী ও উভকামীদের সমস্যা লিঙ্গপরিচয়ের নহে। তাঁহাদের বিশিষ্টতা যৌন মনোভঙ্গি তথা পছন্দের বিষয়ে। যৌনতার মূলধারায় তাঁহারা দলছুট, ফলত একঘরে। সমকামীদের মধ্যে কেহ ট্রান্সজেন্ডার হইতেও পারেন। ট্রান্সজেন্ডারদের মধ্যে কেহ সমকামী থাকিতে পারেন। উভয়েই প্রান্তিক যৌনতার আন্দোলনে অংশ লইয়া থাকেন। তাঁদের একত্রে এলজিবিটি বলিয়া ডাকিবার চলও আছে। কিন্তু তাহাতে এই শব্দগুলির নিজস্ব গোত্রভেদ ঘুচিয়া যায় না। সরকার এই অআকখটুকু মনে রাখিলে সমাজের কল্যাণ হয়, আদালতেরও সময় বাঁচে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement