বছরের শেষে ফিরে তাকানো যতটা সহজ, সাম্প্রতিক অতীতের আবর্জনা দূর করা ততোধিক কঠিন। আজ আমাদের মনে ২০২০ অতিমারির বছর হিসেবে চিহ্নিত, এই অদ্ভুত কালটিকে পিছনে ফেলে আসার জন্য সকলেই উদ্গ্রীব। ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কিন্তু বিশ্বসমাজ ২০২০-কে কেবলমাত্র করোনা রোগের বছর বলে না-ও মনে রাখতে পারে। ইতিহাসের আতশকাচে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো দেখবে, কী ভাবে একটি নবাগত ভাইরাস মানুষে মানুষে বৈষম্য-বিদ্বেষ-বিভেদের রোগকে আরও প্রকট করে তুলেছিল।
কোভিড সম্বন্ধে একটি প্রচলিত ধারণা যে, এই অসুখ ধনী-দরিদ্র ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীন নির্বিশেষে সকলকেই কাবু করতে পারে। তাই নয় কি? আমরা দেখে আরও আশ্চর্য হই যে, সংক্রমণের এই ছোট অদৃশ্য বীজ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিত্তশালী দেশকে নতজানু করে ফেলল। পৃথিবীর মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ বাস করেন আমেরিকায়, অথচ বিশ শতাংশের বেশি কোভিডে মৃত্যু ঘটেছে সেই দেশে। তার কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা, অপদার্থতা ও উদাসীনতার মিশেল। তবে কাছ থেকে দেখলে আরও লক্ষণীয় যে, আমেরিকার শহরে-শহরে, গঞ্জে-গঞ্জে দরিদ্র আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিকদের মৃত্যুর হার ও হাসপাতালে ভর্তির হার সাধারণ গড়ের চাইতে অনেক অনেক বেশি।
২০২০-র বেশির ভাগটা আমার কেটেছে গৃহবন্দি অবস্থায় কম্পিউটার পর্দার সামনে— প্রায় আট মাস বস্টনে, বাকি সময়টা কলকাতায়। বছরের যে ছবিটা আমার সারা জীবন মনের মধ্যে গেঁথে থাকবে, তা হল এক অসহায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ঘাড়ে এক নিষ্ঠুর শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাঁটু। মৃত্যুপথগামী মানুষটি কেবলই বলছেন, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না’, এবং তাঁর স্বর্গত মাকে ডাকছেন। ২০২০-র কাহিনি বাঁধা পড়েছিল এই বেদনাময় ছবিতে, কারণ বিশ্বের সর্বত্রই, আমাদের দেশেও, দরিদ্র সংখ্যালঘুর স্কন্ধে অত্যাচারীরা চেপে বসেছে।
আমেরিকার সমাজ ও রাষ্ট্র অনেকটাই বর্ণবৈষম্য ও বর্ণবিদ্বেষের উপর প্রতিষ্ঠিত। অথচ অতিমারির মধ্যেও নানা রঙের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ-তরুণী— জর্জ ফ্লয়েড, ব্রিয়োনা টেলর ও অন্যদের নাম উচ্চারণ করতে করতে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পথে নামলেন। শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলন করার অধিকার ও রাষ্ট্রের তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সংঘাতের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হল আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, স্বৈরতন্ত্র-পসন্দ ডোনাল্ড ট্রাম্প শত অপচেষ্টা করেও আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুরমুশ করতে সফল হননি। ভারতবর্ষের সঙ্গে একটি বড় তফাত— আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশ নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষায় সক্ষম। এত বিদ্বেষবন্যার মধ্যেও ভারতীয় ও ক্যারিবিয়ান বংশোদ্ভূত এক জন আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলা ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
এই বছরের গোড়ায় আমাদের দেশেও সমান নাগরিকত্বের দাবিতে নানা সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ প্রতিবাদের পথে নেমেছিলেন। নভেম্বর মাসে দেশে ফিরে দেখলাম যে, অতিমারির সুযোগ নিয়ে বেশ কিছু বেআইনি আইনের সাহায্যে ও আইনের অপব্যবহার করে কেন্দ্রীয় সরকার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী আন্দোলনের পরিসর খাটো করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা এখন খুবই করুণ। নরেন্দ্র মোদী গত কয়েক দিন ধরে যে গণতন্ত্রের গুণগান গাইছেন, তা ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনকালের ডায়ার্কিকে হার মানায়, যে ডায়ার্কির বিরুদ্ধে চিত্তরঞ্জন দাশের মতো নেতারা লড়াই করেছিলেন। ক্ষমতার কিছু উচ্ছিষ্ট স্থানীয় স্তরে ছিটিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অপশাসন মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানের সামরিক শাসক আয়ুব খানের ‘বেসিক ডেমোক্র্যাসি’ বা জিয়াউল হকের ‘লোকাল ডেমোক্র্যাসি’র ভাঁওতার কথা। কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রীর অপরিকল্পিত খামখেয়ালি লকডাউন পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনে চরম দুর্দশা ডেকে এনেছিল। দিল্লির বাইরে যে সব কৃষক কর্পোরেটপ্রেমী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাঁদের বশ্যতা স্বীকার করানো কেন্দ্রের পক্ষে খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।
অতিমারির বছরের অর্থনৈতিক ক্ষতি যে দীর্ঘস্থায়ী হবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক পুনরুন্নয়নের জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সমন্বয়, নিজের সীমানার মধ্যে গুটিয়ে যাওয়া নয়। আমেরিকার সৌভাগ্য যে, নতুন বছরে জো বাইডেনের নেতৃত্বে নতুন প্রশাসন বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। প্রথম পদক্ষেপই হবে প্যারিস পরিবেশ চুক্তিতে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাতে পুনঃপ্রবেশ। অন্য দিকে আজ ব্রিটেন তার ২০১৬ সালের ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসার আত্মঘাতী ব্রেক্সিট সিদ্ধান্ত রূপায়িত করতে চলেছে।
আত্মনির্ভরতার নামে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও এ বছর একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ন’বছর আলোচনায় যোগদানের পরেও পনেরোটি এশীয় দেশের রিজিয়োনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) নামক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে অংশগ্রহণ না করে ভারত একুশ শতকের এশীয় পুনরুন্নয়নের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। দুঃখের বিষয় যে, আমাদের স্বদেশি আন্তর্জাতিকতাবাদের ইতিহাস সম্বন্ধে আজকের নেতৃবৃন্দ সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ট্রাম্প-মোদী দহরম-মহরম ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপিত হওয়ার পর আমাদের প্রজাতন্ত্র দিবসে আমরা প্রধান অতিথি হিসেবে ডেকে আনছি চার্চিলের অনুরাগী বরিস জনসনকে। তাঁর উগ্র দক্ষিণপন্থী সরকারের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার, তা আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার বাদে আর সকলের কাছেই পরিষ্কার।
সমগ্র ভারতে বৈষম্য-বিদ্বেষ-বিভেদের রাজনীতির আবহেই নতুন বছরে আসছে বাংলার কঠিন পরীক্ষা। ইতিহাসে বাঙালির আত্মঘাতী হওয়ার নিদর্শন আছে, যা দেখা গিয়েছিল ১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গ-দেশভাগের সময়। আবার নিজের আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান বজায় রেখে ভারতকে পথ দেখানোর ঐতিহ্যও জোরালো। আশা থাকল, বাংলা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়ে ইতিহাসবোধ ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেবে।
২০২০-র শেষ লগ্নে কেন্দ্রের শাসক দলের এক সাংসদ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বদলের ডাক দিয়ে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ এক চতুর চাল চেলেছেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণমন’ জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অর্কেস্ট্রেশন করে সেটি ইউরোপে বাজানো হয়েছিল নেতাজির অনুপ্রেরণায়। সিঙ্গাপুরে আজ়াদ হিন্দ সরকারের গঠনের পর রবীন্দ্রনাথের গানের মর্ম যাতে আজ়াদি সৈন্য সহজে বুঝতে পারে, তার জন্য একটি সরল উর্দু-ঘেঁষা হিন্দুস্থানি রূপের ব্যবস্থা নেতাজি করেছিলেন। পঞ্জাবের লায়ালপুর শহর থেকে আসা কবি মুমতাজ হুসেনের হিন্দুস্থানি তর্জমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের সাদৃশ্য পরিষ্কার। নানা স্থানের নামের মধ্যে অবশ্যই সিন্ধু ছিল, কেবল ‘জয় হে’ কথাটি ‘জয় হো’-তে রূপান্তরিত হয়েছিল।
তবে আজকের দিনে ‘জনগণমন’-র দ্বিতীয় স্তবকের সঙ্গে হিন্দুস্থানি গানের ভাবের মিল আরও বিশেষ করে স্মরণ করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ ‘জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক’-এর উদ্দেশে লিখেছিলেন: “অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী/হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী/পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে/প্রেমহার হয় গাঁথা।” নেতাজির নির্দেশে মুমতাজ হুসেনের ভাষ্যে সেটি হল: “সবকে দিল মে প্রীত বসায়ে তেরি মিঠি বাণী/ হর সুবে কে রহনেওয়ালে হর মজহব কে প্রাণী/ সব ভেদ অউর ফরাক মিটাকে সব গোদ মে তেরি আকে/গুঁধে প্রেম কি মালা।”
বর্ষশেষে বিদ্বেষ-বিভেদকে বিদায় জানিয়ে, সমস্ত ভেদ ও ফরাক মিটিয়ে, আমরা সুবহ ও মজহবের মধ্যে প্রেমহার গাঁথতে পারব কি?
ইতিহাস বিভাগ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি