প্রতীকী ছবি।
কলকাতা হাইকোর্ট এ বারের কালীপুজো ও দেওয়ালিতে বাজির ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পর বোধ হয় সবচেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন পরিবেশ দফতর-সহ রাজ্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। জাতীয় পরিবেশ আদালতের সাম্প্রতিক রায়ও সেই নিষেধাজ্ঞাকে মান্যতা দিয়েছে।
কয়েকটি রাজ্যে আসন্ন দেওয়ালিতে বাজি সম্পূর্ণ বারণ হওয়ার সরকারি নির্দেশ বেরোনো ও তার পর চিকিৎসক এবং পরিবেশবিদরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একই দাবি জানানোর পর তাঁরা বুঝেছিলেন, এ বছর কালীপুজো ও দেওয়ালিতে সব রকমের বাজি ব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিত। বাজি ফাটানোর কারণে হওয়া বায়ুদূষণের ফলে কোভিড আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থার অবনতির আশঙ্কায় যথেষ্ট সারবত্তা আছে, যাঁরা সদ্য কোভিড থেকে ফিরেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু বাজি সম্পূর্ণ বন্ধ করার মতো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বদলে, মানুষের সচেতনতার উপরই বিষয়টা ছেড়ে দিতে হচ্ছিল; যে হেতু রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেটাই চাইছিলেন।
সুতরাং, আবারও সেই আদালত ভরসা। বস্তুত রাজ্যে ও দেশে এখন এটাই দস্তুর। গত তিন দশকে পরিবেশ বিষয়ে যে কোনও প্রশ্নেই প্রশাসনিক অবহেলা ও গয়ংগচ্ছ ভাব স্পষ্ট। জাতীয় ক্ষেত্রে ১৯৮৫ সালে এম সি মেহতা’র বিখ্যাত গঙ্গা মামলা দিয়ে শুরু। তার পর নর্মদা মামলা থেকে গোয়া মাইনিং মামলা, ঝাড়গ্রামের পাথরখাদানে দূষণের ফলে সিলিকোসিসের মামলা, দিল্লিতে গাড়ির ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণের মামলা, যমুনার তীরে দূষণের অভিযোগে মামলা।
এই রাজ্যেও একই ছবি। নব্বইয়ের দশকে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বাঁচানো, শব্দদূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে কলকাতায় দূষণের কারণে ১৫ বছরের পুরনো বাণিজ্যিক গাড়ি বাতিল করা, কিংবা দেওয়ালিতে বাজির উপদ্রব— যাবতীয় সমস্যা সামলাতে আদালতকেই এগিয়ে আসতে হয়। এমনকি দূষণের কারণে কলকাতার বইমেলা বা হাওড়ার মর্গ কী ভাবে সরবে বা পরিবেশ বান্ধব সিএনজি গ্যাস কবে আসবে, এই ধরনের আদ্যন্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তও কিন্তু নিতে হয়েছে আদালতকেই। নিয়ম করে নজরদারি করতে হয়েছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আদালত রায় দিয়েছে দেশের ও রাজ্যের আইনের উপর ভিত্তি করেই, যেটা সহজেই প্রশাসন করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। বস্তুত নিজে থেকে করা তো দূরস্থান, আদালত রায় দেওয়ার পরও কেবল বিজ্ঞাপন দিয়ে আর আলমারিতে ধুলো-পড়া ফাইলে সই করেই দায় সারে প্রশাসন। কিছু দিন আগে সুন্দরবনে হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে এক দিদি বলছিলেন, কী ভাবে বহু বছর ধরে প্রায় প্রতি দিন জোয়ারের জল গোটা অঞ্চলের সমস্ত ঘরবাড়ি প্লাবিত করে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, প্রশাসন কী করছে? তিনি নির্লিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন, প্রশাসন তো এখানে আসে না !
ঠিক একই ভাবে, প্রশাসন স্রেফ ‘অনুপস্থিত’ থাকে, যখন আদালতের রায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পূর্ব কলকাতার জলাভূমিতে বেআইনি বাড়ি ওঠে। কিংবা যখন ভোররাত অবধি পাড়া দূরস্থান, হাসপাতাল কাঁপিয়ে শব্দবাজি ফাটে।
কিছু দিন আগে কেন্দ্রীয় পরিবেশ দফতরের তৈরি কমিটি এই রাজ্যে রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো পরিবেশের কারণে হওয়া উচিত নয়, এমনটা বলার পরেও সরকার ছটপুজো করতে আদালতের দ্বারস্থ হল। বাম সরকার, তৃণমূল সরকার নির্বিচারে এটাই গত কয়েক দশকের প্রবণতা। বাম আমলে সুন্দরবনে একটি বড় কোম্পানিকে মেগা পর্যটনের পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হয়, যদিও পরে তা প্রত্যাহারও করা হয়। ওই আমলেই দক্ষিণ কলকাতার এক বিশাল আবাসন প্রকল্পের উপর যাবতীয় বিধিনিষেধ কার্যত লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল সরকারি অঙ্গুলিহেলনেই। স্থান, কাল, পাত্র পাল্টিয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়নি।
আর এখানেই লুকিয়ে একটা জরুরি কথা— পরিবেশ দফতর বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আইনের হিসেবে যথেষ্ট বলীয়ান হয়েও কেন পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে না, তার কারণ। পরিবেশ নষ্ট করার একটা বেআইনি কিন্তু বিশাল, সমান্তরাল ও তাৎক্ষণিক বাজার আছে, যার সঙ্গে যুক্ত পরিবেশ আইনভঙ্গকারী শিল্পসংস্থা বা মুনাফাভোগীরা, এবং কিছু রাজনীতিবিদ ও এক শ্রেণির তাঁবেদার প্রশাসন। এই বেআইনি বাজার এতটাই শক্তিশালী যে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বার বার বলা সত্ত্বেও নদীর বালি তোলা বন্ধ হয় না। মাত্র ৩১টি নিয়মানুগ বাজির কারখানা রাজ্যে থাকা সত্ত্বেও পঞ্চাশ হাজারের বেশি কারখানার কথা জোর গলায় প্রকাশ্যে বলেন বাজি ব্যবসায়ীরা।
তাই আশ্চর্য নয় যে, অতিমারির সময়ে মৃত্যুর মিছিল দেখেও, বাজি বন্ধ করতে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার উদ্যোগ করে না। মানুষের জীবন বাঁচাতে শেষে আদালতকেই এগিয়ে আসতে হয়। অথচ আদালতের উপর এই নির্ভরতা গণতন্ত্রে ভাল লক্ষণ হতে পারে না। যত দিন না পরিবেশ দফতর বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ স্বাধীন ভাবে কাজ করার পরিসর পাচ্ছে, তত ক্ষণ আদালতই ভরসা।