রাজা বদল হয়েছে। বদলে গিয়েছে জমানা। এখনও পাঁচ বছর চাকরি ছিল গৌর ভট্টাচার্যির। কিন্তু আর নয়। শিক্ষকতায় ইস্তফা দিয়ে তিনি ফিরে চললেন মোবারকপুর, নিজের বাসভূমিতে। সেই কত-কত বছর আগে মোবারকপুর ছেড়ে পরিবারকে সঙ্গে করে তিনি চলে এসেছিলেন বলরামপুরে! মনে উচ্চাশা, তাঁর সংস্কৃতবিদ্যার কদর করবে বলরামপুর, হবেন মানুষ গড়ার কারিগর।
এ কাজে ডাক দিয়েছিলেন তাঁর বলরামপুরেরই এক বন্ধু। কিন্তু এসে দেখলেন, বন্ধু নেই। তিনি কাশীবাসী হয়েছেন। গৌর পণ্ডিত ফিরে গেলেন না। থেকে গেলেন। আর শুধু থেকেই গেলেন না, ‘বলরামপুর ভ্যারাইটি স্টোর্স’ এর মালিক মথুর সাহা, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান গোবিন্দ চক্রবর্তীর সহযোগিতায় তৈরি করে ফেললেন একখানা স্কুল, ‘বলরামপুর হাইস্কুল’।
তাঁকে হেডমাস্টার করেই স্কুল শুরু হয়েছিল। কিন্তু স্কুল বড় হল। প্রথমে ‘হাই’ পরে ‘হায়ার সেকেন্ডারি’। হেডমাস্টারের উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার পড়ল। একদা তাঁরই ছাত্র ভবরঞ্জন হলেন হেডমাস্টার। তৈরি হল নতুন কমিটি। এল নতুন শিক্ষকের দল। তাঁদের কেউ চেনা, কেউ অচেনা। স্কুলের রাশটা অবশ্য থেকে গেল গৌর পণ্ডিতের হাতেই। সব কাজেই তিনি। এমনকি ফাঁকিবাজ, স্কুলের নিয়ম মাফিক চলতে না-চাওয়া শিক্ষকদের শাসন করার ব্যাপারটাতেও হেডমাস্টারের আগে তিনি।
স্কুলই তাঁর ধ্যনজ্ঞান। ছাত্রদের জন্যই তিনি নিবেদিত প্রাণ। ফলে, শিক্ষকদের মাইনে বাড়ানোর আবেদনেও তিনি পথের কাঁটা। এটা সেই সময়ের গল্প যখন ছাত্রদের মাইনে থেকেই বেতন পেতেন শিক্ষকেরা। শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে গেলে বাড়াতে হবে ছাত্রদের বেতন। সেটা গৌর পণ্ডিতের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। ফলে স্বভাবতই তিনি বিরুদ্ধে। এমন শিক্ষকের সঙ্গে অন্য শিক্ষকদের সঙ্ঘাত অনিবার্য। হলও তাই। সঙ্ঘাত এক দিন এমন জায়গায় চলে গেল যে, নিজের তৈরি স্কুল থেকেই বিদায় নিতে হল
গৌর পণ্ডিতকে।
বিমল মিত্রের ‘রাজাবদল’ উপন্যাসের এই আদর্শবাদী শিক্ষকের মতো চরিত্র বাংলা সাহিত্যে কিন্তু অনেক। আবার সেই অর্থে আদর্শবাদী নন কিন্তু মনে রাখার মতো শিক্ষক চরিত্রও রয়েছেন বেশ কয়েক জন। যাঁরা পরাধীন বাংলায় ভাঙা এই পেশায় ভাঙা জীবন নিয়ে রচনা করেছেন ভিন্ন আখ্যান। শিক্ষক-কেন্দ্রিক, শিক্ষালয়-কেন্দ্রিক বিভিন্ন উপন্যাসে, গল্পে ছড়িয়ে রয়েছেন এই সব চরিত্র। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে এমন কয়েক জন শিক্ষক কিংবা শিক্ষালয়-কেন্দ্রিক কয়েকটা উপন্যাসের পাতা আরও এক বার উল্টে নেওয়া যেতেই পারে।
শিক্ষক-কেন্দ্রিক বেশির ভাগ উপন্যাসেই শিক্ষকেরা আদর্শবাদী, সৎ এবং বিপন্ন এক প্রজাতি। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি কিন্তু সব জায়গায় এক নয়। গৌর পণ্ডিতকে লড়তে হয়েছিল স্কুলের বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে। এর বহু যুগ আগে লেখা তারাশঙ্করের ‘সন্দীপন পাঠশালা’য় সীতারাম পালকে লড়তে হয়েছিল জাতপাত আর সঙ্কীর্ণ গ্রাম্য রাজনীতির সঙ্গে।
জাতিতে সদগোপ সীতারাম পড়াশোনা শেখার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে বড় হয়েছিলেন। কিন্তু সাধ, তাঁর মেধার সীমাবদ্ধতার কাছে হার মানল। নর্মাল পাশের স্বপ্ন ছিল তাঁর। কিন্তু হুগলি থেকে তিনি গ্রামে ফিরলেন নর্মাল
ফেল হয়ে।
পড়াশোনায় অসফল সীতারামকে তাঁর বাবা রমানাথ বললেন, ‘ঘরে বসে চাষবাস দেখ।’ নর্মাল পাশ করেও সীতারাম যা হতেন, আসাফল্য নিয়েও তিনি তাই-ই হতে চাইলেন। পাঠশালার শিক্ষক। পার্শ্ববর্তী রত্নহাটা গ্রামে শুরু হল তাঁর পাঠশালা। নামটি বড় চমৎকার। কৃষ্ণ-বলরামের শিক্ষক সান্দীপনি মুনির পাঠশালার নামে ‘সন্দীপন পাঠশালা’।
প্রথমে শুরু হয়েছিল সাহা-জেলে-কৈবর্তদের পাড়ায়, কিন্তু সে পাঠশালা টিকল না। একে তো সদগোপের ছেলের শিক্ষকতায় ঘুলিয়ে উঠল উচ্চবর্ণকেন্দ্রিক গ্রাম্য রাজনীতি। তার উপর পাঠশালা তাঁদেরই চক্রান্তে কোপে পড়ল ইংরেজ সরকারের। যে পরিবারে গৃহশিক্ষকতা নিয়ে তাঁর রত্নহাটা আসা, সেই পরিবারের বড় ছেলে ধীরানন্দ গাঁধীজির অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হলেন। স্কুল ছুটি দিয়ে সেই পরিবারের পাশে দাঁড়ালেন সীতারাম। গ্রামের উচ্চবর্ণের মাতব্বরেরা নালিশ করলেন সরকারের উঁচু মহলে। স্কুলের অনুদান বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল স্কুল। দমার পাত্র নন সীতারাম।
কিছু দিন পরে রত্নহাটা গ্রামের অশ্বত্থতলায় তিনি শুরু করলেন নতুন ভাবে। গাছের কাণ্ডতে সীতারাম লিখে দিলেন—‘রত্নহাটা সন্দীপন পাঠশালা।’ ছাত্র সংখ্যা পাঁচ। শুরু হল শিক্ষকতায় সীতারামের পুরোপুরি আত্মনিয়োগ। এই পর্বে গ্রাম্য রাজনীতি থেকে তিনি কিছুটা মুক্ত। উপরন্তু শিক্ষক হিসাবে পেলেন একের পর এক সাফল্য। সীতারামের নিষ্ঠায় ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় তাঁর অনেক ছাত্রই বৃত্তি পেয়ে চলল পরপর। নর্মাল পাশ না করা পাঠশালার শিক্ষক সীতারামকে নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে সাহিত্যিক হয়ে যাওয়া ধীরানন্দ বই লিখতে চেয়েছিলেন। উপন্যাসের শেষে অর্থাভাবে চোখের চিকিৎসা করাতে অপারগ প্রায়-অন্ধ সীতারামের বাড়িতে এলেন ধীরানন্দ। এসে নিয়ে গেলেন তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিখে রাখা নোটবইখানা।
মনোরম এই উপন্যাস পড়তে বসে একেবারে না শেষ করে বোধহয় আমরা কেউই উঠিনি। যেমন উঠিনি নারায়ণ সান্যালের ‘প্যারাবোলা স্যার’ পড়ার সময়। ‘প্যারাবোলা স্যার’ নামটাই বড় অদ্ভুত। ভবতারণ এইচ ই স্কুলের ক্লাস টেনের শ্রেণি শিক্ষক সুশীলবাবুর অনুপস্থিতিতে সে দিন ওখানে পাঠানো হয়েছিল থার্ড মাস্টার সত্যবান চক্রবর্তীকে। ইংরেজির ক্লাস। কিন্তু তিনি অঙ্কের। ভেবেছিলেন অঙ্ক দিয়েই ক্লাসটা পার করবেন। কিন্তু ছেলেরা ইংরেজি পোয়েট্রির ক্লাসে অঙ্ক করতে চাইল না। অগত্যা ইংরেজিই পড়াতে লাগলেন। ছেলেরা যে কবিতাটা পড়ানোর জন্য বাড়িয়ে দিল, শেলির সে-কবিতা সত্যবান স্যর ম্যাট্রিকে পড়েছিলেন। তাই পড়াতে অসুবিধা হল না।
কিন্তু শেলির ‘To a Skylark’ পড়াতে গিয়ে উনি একটু বাড়তি প্রসঙ্গের অবতারণা করে ফেললেন। টেনে আনলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘To the Skylark’ কবিতা। দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘শেলির ভরতপক্ষী হচ্ছে দেহাতীত আত্মা। আর ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভরতপক্ষী পার্থিব বন্ধনকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারে না।’
ব্যাপারটা একটু ভাল ভাবে বোঝানোর আবদারে তিনি আর তাল রাখতে পারলেন না। ঢুকে গেলেন অঙ্কে। একটা খাড়া লাইন এঁকে বললেন, ‘শেলির স্কাইলার্ক হল এ রকম। ডাইনে বাঁয়ে তাকায় না, খাড়া উঠে যায়।’ এরপর একটা প্যারাবোলা এঁকে বললেন, ‘ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্কাইলার্ক হল এই প্যারাবোলা। প্যারাবোলার ধর্ম হল সমান নজর রাখতে হয় দু’দিকে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্কাইলার্কের ধরনটাও তাই।’
সে দিন সাপ্লিমেন্টারি ক্লাস থেকে খালি হাতে ফিরলেন না সত্যবান চক্রবর্তী। তিনি সারাজীবনের জন্য একটা নতুন নাম পেলেন, ‘প্যারাবোলা স্যার’।
শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল