এ বছর ভারতে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়নের (১৯২০) শতবর্ষ। দেশের শ্রমিকদের এখন বড় দুঃসময় চলছে। ভিন্ রাজ্য থেকে পায়ে হেঁটে, বাসে-ট্রাকে ঘরে ফিরতে গিয়ে পথশ্রমে, অনাহারে, পথ দুর্ঘটনায় প্রতি দিন মারা যাচ্ছেন শ্রমিকরা। খেটে-খাওয়া মানুষের প্রতি সমাজের নিষ্ঠুরতা, অবজ্ঞা, অজ্ঞতা যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। শতবর্ষের মাইলফলক তাই এ দেশের শ্রমিক সংগঠনের কাছে যত না উদযাপনের সময়, তার থেকে বেশি আত্মবীক্ষার সময়। পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনরক্ষা, মর্যাদা রক্ষায় এই চরম ব্যর্থতা কি শ্রমিক আন্দোলনেরও ব্যর্থতা নয়?
মূল স্রোতের ট্রেড ইউনিয়নগুলি সংগঠিত ক্ষেত্র নিয়ে চিরকাল ব্যস্ত থেকেছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের সেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। দেশের শ্রম আইনের সিংহভাগ সংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের স্বার্থের সুরক্ষার জন্য। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীরা কার্যত শ্রম-সংক্রান্ত আইনের সুরক্ষার বাইরে। এঁদের কাজের নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, বাসস্থানের সমস্যা, চিকিৎসার অভাব ইত্যাদি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলি কি কখনও খুব সচেষ্ট ছিল? এখন হয়তো প্রায় অনাহারে থাকা দিনমজুরদের নিয়ে তারা চিন্তিত। কিন্তু ট্রেড ইউনিয়নেরই দায় ছিল অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিক, এবং বড়-মাঝারি শিল্পে অস্থায়ী কর্মীদের সংগঠিত করা। সেই দায় পালনে অপারগতা প্রকট হয়েছে। আজ অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রায় চুয়াল্লিশ কোটি শ্রমজীবী মানুষ এক নেই-রাজ্যের বাসিন্দা। শ্রমিক সংগঠনগুলি তা বুঝেও উপেক্ষা করেছে। নয়া উদারনীতির যুগেও তারা সাবেকি ধারায় আন্দোলন করে গিয়েছে। নতুন চিন্তা করেনি, নতুন ধারণাকে স্বাগত জানায়নি।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের গতি, প্রকৃতি ও অভিমুখ প্রসঙ্গে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবকে স্বীকার করতে হলে ভাবতে হবে, মূল স্রোতের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো কি দীর্ঘ কাল প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গেই সমঝোতা করেনি? শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি আজ প্রাতিষ্ঠানিকতার বেড়াজালে আটকে পড়েছে। আবার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বেরিয়ে আসার পথও খুঁজে চলেছে। তবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির ব্যবধান দুস্তর। সেই ব্যবধান ঘোচানো বড় পরিশ্রমের কাজ। মাটি কামড়ে লেগে থাকার কাজ।
আজ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকদের নিয়ে সরব। এই উদ্বেগ আন্তরিক। তারা প্রশ্ন তুলছে, ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকদের হিসেব সরকারের কাছে নেই কেন? জরুরি প্রশ্ন। কিন্তু সেই হিসেব কি ট্রেড ইউনিয়নগুলির কাছেই আছে? দেশের কোন প্রান্তে কত জন পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন, তাঁদের কাজের শর্ত কেমন, মজুরির হার কত, তার সার্বিক চিত্র কিন্তু শ্রমিক সংগঠনের কাছেও নেই। এই সব প্রান্তিক শ্রমিকদের নিয়ে কোনও নমুনা সমীক্ষাও ট্রেড ইউনিয়নগুলি করেনি, যা সরকারের বঞ্চনা ও অকর্মণ্যতার একটা ছবি অন্তত তুলে ধরতে পারে।
ট্রেড ইউনিয়নগুলির এই উপেক্ষার কারণ হয়তো এই যে, দেশের শ্রমিকদের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে মূল স্রোতের ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির কার্যত কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠনগুলিও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সঙ্গে নেয়নি, তাদের অধিকারের আন্দোলনে শামিল হয়নি। দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের ট্রেড ইউনিয়নগুলো দুনিয়ার মজুরদের এক করার স্লোগান তুলেছে, কিন্তু কাজের বেলায় নেতা-কর্মীরা নিজেদের আর্থ-সামাজিক গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। এমনকি একই শিল্পক্ষেত্রের স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিকদের মধ্যেও বোঝাপড়া নেই। দেখা যাচ্ছে, সংগঠিত ক্ষেত্রে যে সব কর্মী উচ্চ বেতনভোগী, তাঁরা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সুবিধাটুকু চান, কিন্তু আন্দোলনের সময়ে পুলিশের লাঠি-গুলির মুখে ঠেলে দেন অস্থায়ী, দরিদ্র কর্মীদের। আন্দোলনের দায় নিতে তাঁরা অপারগ। ট্রেড ইউনিয়নের পরিধির মধ্যে সংগঠিত ও অসংগঠিত শক্তির সমন্বয়ের অভাব রয়েই গিয়েছে। এই অনৈক্যের ফলেই সরকারের সঙ্গে লড়াই করে ন্যায্য পাওনা, সুরক্ষা আদায়ের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। প্রতিবাদের ওজন কম, হয়তো এই কারণেই সরকার এতখানি দুর্বিনীত হতে পেরেছে।
শ্রমিকেরা নিজেরাই প্রমাণ করেছেন, প্রয়োজনে তাঁরা কতখানি মরিয়া হতে পারেন। শ্রমিককে বাড়ি ফিরতে না দিয়ে কাজের শহরে বন্দি করে রাখার রাষ্ট্রীয় ফন্দি যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও শ্রমিকেরা বানচাল করে দেবেন, সরকার তা ভাবতে পারেনি। কিন্তু এর পর শ্রমিক কাজের জায়গায় ফিরে না এলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। শ্রমিক শ্রমশক্তি না বেচলে উৎপাদন ব্যবস্থাটাই অচল হয়ে যাবে। অথচ এই দুঃসময়ে মজুরি কমানো, কাজের সময় বাড়ানো ও অবাধে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের নীতি নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ ভাবে কি অর্থনীতিকে সচল রাখা যাবে? চাহিদা কমে মন্দা আরও গভীর হওয়ার বিপদ তো আছেই। কিন্তু, বিপদ কেবল সেখানেই নয়। শ্রমিকরা বাড়ি ফিরছেন। এখন কাজের জায়গায় তাঁদের মজুরি কমে গেলে, ছাঁটাইয়ের আতঙ্ক থাকলে, আর কিন্তু অনেকেই কাজে ফিরে যাবেন না। যেমন পশ্চিমবঙ্গের চটকলে ফিরে না-ও আসতে পারেন অনেক দক্ষ ও আধাদক্ষ শ্রমিক। তাঁদের মজুরি এমনই যৎসামান্য, আরও মজুরি কমলে, সুরক্ষা উঠে গেলে, তাঁরা বিকল্প কাজ খুঁজবেন। যাঁদের জীবিকার নিশ্চয়তা নেই, তাঁদের জীবিকা বদলাতেও বেশি ভাবতে হয় না। তখন শ্রম আইন বদলের খেলাটাই নীতিনির্ধারকদের কাছে বুমেরাং হতে পারে।