যদি প্রতিষেধক না আসে, স্কুলও শুরু নহে— এই মর্মে অভিভাবকদের স্বাক্ষর অভিযান শুরু হইয়াছে সমাজমাধ্যমে। ৩১ মে শেষ হইয়াছে চতুর্থ দফার লকডাউন। অতঃপর তালা খুলিবার পালা। ধাপে ধাপে দেশকে সচল করিতে সহমত হইয়াছে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি খুলিবার ক্ষণটিও সমাগতপ্রায়। কোন তারিখ হইতে, তাহা এখনও স্থির হয় নাই। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্যের ঘোষণা হইতে অনুমান, আগামী জুলাই হইতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলিতে পারে। জুলাই, অর্থাৎ হাতে আর মাত্র এক মাস সময়। প্রসঙ্গত, ভারতে বর্তমানে কোভিড-আক্রান্তের সংখ্যা দুই লক্ষ অতিক্রান্ত। প্রতি দিন গড়ে আট হাজার মানুষ আক্রান্ত হইতেছেন। আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে পরিস্থিতির ততটা উন্নতি হইবে কি, যাহাতে বিদ্যালয়-জীবন শুরু করা যায়? সম্ভাবনা ক্ষীণ। চটজলদি সিদ্ধান্ত পড়ুয়াদের চরম বিপদের মুখে ঠেলিয়া দিতে পারে— অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা ইহাই।
উৎকণ্ঠা অকারণ নহে। যেন একটু বেশিই দ্রুত এই সিদ্ধান্ত। শোনা গিয়াছে, সর্বত্র একই সঙ্গে সমস্ত বিদ্যালয় খুলিবে না। গ্রিন এবং অরেঞ্জ জ়োনের বিদ্যালয়গুলি প্রথমে খুলিবে অষ্টম হইতে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া লইয়া। উপস্থিতির হার প্রাথমিক পর্যায়ে ত্রিশ শতাংশে আবদ্ধ রাখা হইবে। প্রাথমিক এবং প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পড়ুয়ারা আপাতত বাড়িতেই থাকিবে। মুশকিল হইল, এই ভাবে কি শিক্ষাবর্ষ মান্য করা সম্ভব? দেশের সকল অঞ্চলের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা সম্ভব? না কি গ্রিন ও অরেঞ্জ অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা ক্লাসের পড়া করিবে, রেড জ়োনের শিশুরা না পড়িয়াই পরের ক্লাসে উঠিবে, ইহাই পরিকল্পনা? যে ধরনের সাবধানতা এই ভয়াবহ অতিমারিকে ঠেকাইবার জন্য জরুরি, তাহা কি আদৌ বিদ্যালয়ে শিশুদের পক্ষে পালন করা সম্ভব? বিশেষ করিয়া ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায়, কিংবা দরিদ্র এলাকায়, যেখানে সীমিত পরিসরে সকল ক্লাস চালাইতে হয়? প্রাপ্তবয়স্করাই শারীরিক দূরত্বরক্ষার যে বিবেচনা দেখাইতে ব্যর্থ, অ-প্রাপ্তবয়স্করা তাহা দেখাইবে, এ আশা কি বাস্তবোচিত? দেশের এক বিরাট অংশের নিকট স্বাস্থ্যবিধির প্রাথমিক পাঠটিই অস্বচ্ছ, গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলিতে এখনও উপযুক্ত শৌচাগার নাই, জলের অভাব প্রভূত। কঠোর স্বাস্থ্যবিধি পালিত হইবে কী উপায়ে?
লকডাউন উঠাইবার পিছনে প্রধান চিন্তাটি অর্থনীতি। মহামারি এখনও রীতিমতো উপস্থিত, আক্রান্ত সংখ্যা বরং বাড়িতেছে। তবুও অর্থনীতির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে, মানুষের অভাব-ক্ষুধা-কষ্ট কমাইতে দেশের কিয়দংশে সচলতা আনিবার প্রয়োজনে লকডাউন তুলিতে হইতেছে। বিদ্যালয় শিক্ষা কি সেই আর্থিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে? এক বৎসর কিছু কম শিক্ষালাভ করিলে ক্ষতি হইবে না। বরং মহাবিপর্যয় ঘটিবে, যদি শিক্ষিত করিবার অস্থির তাগিদে বিপুল সংখ্যক শিশু সংক্রমিত হইয়া পড়ে। বিদেশেও স্কুল খুলিবার সিদ্ধান্তের পরিণতি ভাল হয় নাই। ফ্রান্সে স্কুল খুলিতেই পড়ুয়ারা করোনায় আক্রান্ত হইয়াছে। দক্ষিণ কোরিয়াও স্কুল খুলিবার পর দিনই সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে পুনরায় তাহা বন্ধ করিতে বাধ্য হইয়াছে। এই সকল উদাহরণ হইতে শিক্ষা লওয়া জরুরি। তালা খুলিবার প্রক্রিয়ায় বিদ্যালয় সর্বশেষে আসিলেই ভাল। শিক্ষা মূল্যবান, কিন্তু জীবন তাহারও আগে।