শান্তি? পাকিস্তানের সঙ্গে?

শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার কাশ্মীর প্রশ্নে কঠোর হতে পেরেছে

ভারতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হন, যাতে মাউন্টব্যাটেন ভারতের গভর্নর জেনারেল হন। নানা তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের মতো বিশাল ও বিচিত্র দেশের শাসনভার সামলানোর আত্মবিশ্বাস নেহরুর ছিল না। তিনি এমনকি গাঁধীর সহায়তাও নিয়েছিলেন, যাতে মাউন্টব্যাটেন ওই পদে অভিষিক্ত হতে রাজি হন। মাউন্টব্যাটেনের শর্ত ছিল, তাঁর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে, যাতে তিনি তখনকার সঙ্কটপূর্ণ সময়ে যথাযথ রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম হন। নেহরু রাজি ছিলেন। 

Advertisement

জয়ন্তকুমার রায়

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৩০
Share:

সূচনা: দেশভাগ-সহ ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা ঘোষিত হল। (বাঁ দিক থেকে) নেহরু, ইসমে, মাউন্টব্যাটেন ও জিন্না। দিল্লি, ১৯৪৭। গেটি ইমেজেস

যদি বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উন্নতির সম্ভাবনা ক্ষীণ, অমনি অনেকে বলবেন, এটা তো মোদী সরকারের নীতির প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন। এর উত্তরে বলা যায়, মোদী সরকার তো মাত্র কয়েক বছর ক্ষমতায় আছে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের গভীর সমস্যাগুলি অনেক পুরনো। যেমন জম্মু-কাশ্মীর সমস্যা। ১৯৪৭-৪৮ সালে এই সমস্যার মূলে ছিল গভর্নর জেনারেল লুই মাউন্টব্যাটেনের চক্রান্ত। কিন্তু ইংরেজ কর্মকর্তা মাউন্টব্যাটেনের তো স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেল হওয়ার কথাই নয়। নিজের প্রবল ইচ্ছা সত্ত্বেও মাউন্টব্যাটেনকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল করা হয়নি; সে পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না। ভারতে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হন, যাতে মাউন্টব্যাটেন ভারতের গভর্নর জেনারেল হন। নানা তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের মতো বিশাল ও বিচিত্র দেশের শাসনভার সামলানোর আত্মবিশ্বাস নেহরুর ছিল না। তিনি এমনকি গাঁধীর সহায়তাও নিয়েছিলেন, যাতে মাউন্টব্যাটেন ওই পদে অভিষিক্ত হতে রাজি হন। মাউন্টব্যাটেনের শর্ত ছিল, তাঁর হাতেই সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে, যাতে তিনি তখনকার সঙ্কটপূর্ণ সময়ে যথাযথ রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম হন। নেহরু রাজি ছিলেন।

Advertisement

উপরন্তু, নেহরু জল-স্থল-বায়ু সেনার অধিপতি হিসেবে ইংরেজ সেনাপতিদেরই নিয়োগ করেন, যদিও যোগ্য ভারতীয় সেনাপতির অভাব ছিল না। ফলে, ১৯৪৭-এর অক্টোবরে জম্মু-কাশ্মীরে পাকিস্তানি আগ্রাসনের পরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব রইল প্রধানত ব্রিটিশদের হাতে, যারা পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ববশত ভারতের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এমন ভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে যার ফলে ভারতীয় বাহিনীর অবশ্যম্ভাবী বিজয়কে অচলাবস্থায় পরিণত করা হয়। শেষ পর্যন্ত, পাকিস্তানের তুলনায় ভারতীয় বাহিনীর অপরিমেয় উৎকর্ষ সত্ত্বেও জম্মু ও কাশ্মীরের কম-বেশি এক-তৃতীয়াংশ পাক নিয়ন্ত্রণে থেকে গেল।

ওই জন্মগত পাপের ফল এখনও ভারতকে ভোগ করতে হচ্ছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের, যেমন ইমরান খানের বক্তব্য শুনে মনে হবে যে জম্মু-কাশ্মীর চিরকালই পাকিস্তানের অঙ্গ, যদিও সেটা কদাপি সত্য নয়। ভ্রান্তিক্রমে, এবং সংবিধানের প্রধান রচয়িতা অম্বেডকরের আপত্তি সত্ত্বেও, ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারা সংযোজিত হয়। এই ধারা ছিল সম্পূর্ণ অন্যায্য, কারণ এর ফলে ভারতের সব রাজ্যে কাশ্মীরিদের সব রকম অধিকার থাকে, কিন্তু কাশ্মীরে ভারতের অন্য রাজ্যের অধিবাসীদের কোনও অধিকারই থাকে না। তা ছাড়া, অন্যান্য রাজ্যে যে ন্যায়বিচারের সুযোগ বিদ্যমান, সেটি কাশ্মীরে অনুপস্থিত। যেমন, কাশ্মীরি কোনও মহিলা যদি অন্য রাজ্যের কোনও পুরুষকে বিয়ে করেন, কাশ্মীরে তাঁর সম্পত্তির অধিকার থাকবে না। আবার, কাশ্মীরে বহু দিন পূর্বে বাল্মীকি সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাসের জন্য এসেছিলেন। নতুন প্রজন্ম এলেও, তাঁদের কিন্তু আবর্জনা দূরীকরণ ছাড়া অন্য কাজে যোগদানের অধিকার নেই, যদিও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁরা অনেকেই উচ্চশিক্ষিত। ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারার বিলুপ্তির পর জম্মু ও কাশ্মীরেও এই অন্যায় বিচার অন্তর্হিত।

Advertisement

ইমরান খান ৩৭০ ধারা বিলোপকে বেআইনি ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে তাঁর কোনও বক্তব্যই থাকতে পারে না, কারণ জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনি নানা দেশে এ বিষয়ে আন্দোলন করে হাস্যাস্পদ হয়েছেন। পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের ভয়ও দেখিয়েছেন! পাকিস্তান আজও কাশ্মীরে গণভোটের দাবি জানায়, কিন্তু গণভোটের রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রদত্ত শর্ত ছিল: পাকিস্তানকে সমগ্র জম্মু কাশ্মীর ভূখণ্ড থেকে (পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরও এর অন্তর্গত) তার সেনা ও আধা-সেনা অপসারণ করতে হবে। এই শর্ত পালিত হয়নি। জম্মু ও কাশ্মীরে ভারত সরকার অন্যায় অত্যাচার করছে, এটাই পাকিস্তানের অভিযোগ। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধান অবশ্যই কাশ্মীরে বেড়েছে, কিন্তু তাদের একটি গুলিও ব্যয় করতে হয়নি। সাধারণ মানুষ হতাহত হচ্ছেন সন্ত্রাসীদের আক্রমণে।

প্রসঙ্গত, ১৯৫০-এর দশকের শেষ থেকে পাকিস্তানের আইএসআই অতীব সক্রিয় এবং নানা জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তার সখ্য বর্ধমান। নানা সূত্র থেকে সাহায্য লাভ করে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির ক্ষমতাও বেড়েছে। শেষ পর্যন্ত কোনও কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী অতিরিক্ত ক্ষমতাপিপাসু হয়। এই জঙ্গিগোষ্ঠীরা পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশকে একটি সংযুক্ত লীলাক্ষেত্র হিসেবেই গণ্য করে।
পাকিস্তানের অন্যায় মনোভাব স্পষ্ট চিনের সঙ্গে তার ব্যবহার থেকেও। উইঘুর মুসলমানদের প্রতি চিনের অত্যাচারের সমালোচনা করেছে বহু দেশ। কিন্তু পাকিস্তান চিনাদের উইঘুর নীতির কোনও সমালোচনা করেনি। নিজের দেশের অভ্যন্তরে বালুচ ও পাশতুনদেরও মানবাধিকার নিয়মিত লঙ্ঘিত করছে পাক রাষ্ট্র। উল্টো দিকে, কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনে পাকিস্তানের ভূমিকা প্রকট, কারণ পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা বাহিনী (আইএসআই) জম্মু ও কাশ্মীরে নানাবিধ সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য দায়ী। আইএসআই জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষ— শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর নানা জায়গায় তারা সন্ত্রাসী পোষণে বদ্ধপরিকর। আন্তর্জাতিক সংস্থা এফএটিএফ (ফিনানশিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স) জঙ্গিগোষ্ঠীদের আর্থিক সহায়তা দ্বারা লালন পালন করায় পাকিস্তানকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধূসর তালিকা ভুক্ত করা হয়েছে; কালো তালিকাভুক্ত হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক অর্থসাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে।

কিন্তু পাকিস্তান কি সাবধান হচ্ছে? বোধ হয় না। পাকিস্তান কাশ্মীর সীমান্তে অবিরাম যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে। অন্তত ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের পারমাণবিক হুমকি মেনে নিয়ে উপযুক্ত প্রতি-আক্রমণ করেনি। পাকিস্তানের অপকৌশল ছিল এটাই প্রচার করা যে তার সংঘর্ষমূলক কার্যকলাপের প্রত্যুত্তরে ভারত যদি বড় ধরনের কোনও প্রথাগত আক্রমণ করে, পাকিস্তান সঙ্গে সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ করবে।

এই কৌশল বহু বছর কার্যকর ছিল, অর্থাৎ তা ভারতকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে রেখেছিল। ছোটখাটো জবাব দেওয়া হত, কিন্তু বড় ধরনের প্রতিষেধক ঔষধ দেওয়া হত না। ২০১৬ সালে প্রথম কড়া ঔষধ প্রয়োগ করা হল— সার্জিকাল স্ট্রাইক। তবে তা সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চলেই সীমিত ছিল।

২০১৯ সালে ভারতের নীতি ও কার্যক্রমে একটি বিশাল পরিবর্তন দেখা গেল। পুলওয়ামাতে সন্ত্রাসী আক্রমণে নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য নিহত হওয়ায় ভারত তার কার্যক্রমে আমূল পরিবর্তন আনে। পুলওয়ামার কাছাকাছি অঞ্চলে যে সব জঙ্গি লুকিয়ে ছিল, প্রথমে তাদের বিনাশ করা হল। কিন্তু তার পর সীমান্ত থেকে বহু দূরে বালাকোটে জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবিরে আক্রমণ করে ভারত। এ ভাবে পাকিস্তানের পারমাণবিক হুমকিকে অবজ্ঞা করা হল এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনেক দূরে প্রবেশ করার বিষয়ে গণতান্ত্রিক ভারতের যে জড়তা ছিল সেটিও বিসর্জন দেওয়া হল। উপরন্তু বর্তমান ভারত সরকারের যে মূল নীতি— পাকিস্তানের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সম্পূর্ণ স্তব্ধ না হলে কোনও আলোচনা হবে না— সেটাই আরও শক্তিশালী হল।
সংবিধানের অস্থায়ী ৩৭০ ধারা বিলোপের পর জম্মু-কাশ্মীর দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত। পাকিস্তানের এতে তীব্র আপত্তি (যা দস্তুরমতো অনধিকার চর্চা), অথচ পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরও দ্বিখণ্ডিত: উত্তরাঞ্চল (গিলগিট-বাল্টিস্তান) এবং আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর (মুজফ্ফরাবাদ-মিরপুর)। পাকিস্তান জম্মু ও কাশ্মীরে গণভোটের দাবি প্রত্যাহার করেনি, অথচ পাক অধিকৃত কাশ্মীরে গণভোট বা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি উত্থাপন নিষিদ্ধ!

প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিস্থাপন অবশ্যকাম্য। কিন্তু পাকিস্তানের মানসিকতা এতটাই দূষিত যে ভারত যদি নিজে শান্তিস্থাপনের কোনও উদ্যোগ করে, পাকিস্তান তৎক্ষণাৎ এই সিদ্ধান্তে আসবে যে— ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ছায়াযুদ্ধ পরিচালনা করে ক্লান্ত, অতএব অবিলম্বে পাকিস্তানের উচিত ছায়াযুদ্ধের মাত্রা বৃদ্ধি করা। পাকিস্তানের জেহাদি মানসিকতার নানা দিক লক্ষণীয়। সেখানে আহমদিয়া বা শিয়াদের বিরুদ্ধে সংখ্যাধিক সুন্নিদের সংঘর্ষের বিরাম নেই। পাকিস্তানে অস্থিরতার প্রধান কারণ সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রাধান্য। সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা থাকার যুক্তি হিসেবে প্রদর্শিত হয় ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের চিরন্তন শত্রুতা। সামরিক বাহিনীর স্বার্থে এই প্রচার অতিশয় কার্যকর। তারা নিজের স্বার্থে এই প্রচার পরিত্যাগ করতে দেবে না। সে ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সখ্য স্থাপনের অবকাশই থাকে না। ফলে অদূর ভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উন্নতির সম্ভাবনা নিতান্তই ক্ষীণ বলা চলে।

সাম্মানিক অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ,
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement