প্রতীকী ছবি।
ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘মনোদর্পণ’ প্রকল্পের সূচনা করিল কেন্দ্রীয় সরকার। অতিমারির ফলে জীবনযাত্রা বা লেখাপড়া, কোনওটিই আর স্বাভাবিক নাই। এমতাবস্থায় স্কুলপড়ুয়াদের মনের উপর যে বিপুল চাপ পড়িতেছে, তাহার শুশ্রূষাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। উদ্যোগটি জরুরি। ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ন্যায় মানসিক স্বাস্থ্যও একটি প্রাথমিক সমস্যা। তাহাদের পুষ্টি নিশ্চিত করা যেমন রাষ্ট্রের কর্তব্য, তেমনই তাহাদের মনের যত্ন নেওয়ার দায়িত্বটিও রাষ্ট্রকেই লইতে হইবে। শরীর ও মন, দুইয়ের সুস্থতা নিশ্চিত হইলে তবেই কোনও ছাত্র তাহার পঠনপাঠন হইতে লাভবান হইতে পারে। উন্নত গণশিক্ষা ব্যবস্থার জন্যই ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া বিধেয়। অতিমারি আসিয়া এই প্রয়োজনটিকে তীব্রতর করিয়াছে। অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে প্রত্যেক অভিভাবকই বিবিধ সমস্যায় জর্জরিত, যাহার কুপ্রভাব বহুলাংশে সন্তানের উপর পড়িতেছে। তাহারাই সহজ লক্ষ্য, জোরালো প্রতিবাদ করিবার ক্ষমতা নাই, অতএব অধিকাংশ রাগের বহিঃপ্রকাশই সন্তানের অভিমুখে ধাবিত হইতেছে। এমনকি যে পরিবারের শিশুদের প্রতি বিশেষ ভাবে সংবেদনশীল, সেখানেও সার্বিক অনিশ্চয়তার আঁচ লাগিতেছে শিশু-মনে। শিশু-কিশোরদের এই সঙ্গীণ অবস্থায় তাহাদের মনের প্রতি নজর দিবার কাজটি লেখাপড়া শিখাইবার অপরিহার্য অঙ্গ।
সাধারণ ভাবে মানসিক স্বাস্থ্য লইয়া ভারতীয়দের সচেতনতা তুলনায় কম। সমাজ এখনও মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাকে ‘স্বাভাবিক’ ভাবিতে শিখে নাই। ফলে, বহু অভিভাবকই সন্তানের মানসিক সমস্যাকে চিহ্নিত করিতে ব্যর্থ হন। তিরস্কার করিয়া, শাস্তি দিয়া সেই ‘ব্যাধি’ সারাইবার চেষ্টা করেন। ফল স্বভাবতই বিপরীত হয়। যে অভিভাবকরা বুঝেন যে সন্তানের পেশাদারি সাহায্য বা চিকিৎসা প্রয়োজন, বহু ক্ষেত্রেই তাঁহারাও সেই সাহায্যের ব্যবস্থা করিয়া উঠিতে পারেন না। জ্বরজারি হইলে ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া যতখানি সহজ, সন্তান অবসাদের ভুগিলে তাহার জন্য ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া বহু অভিভাবকের পক্ষেই তত সহজ নহে। ফলে, সরকার যদি স্কুলছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্যের দেখভালে প্রকল্পের সূচনা করে, তাহার একাধিক লাভ— সামাজিক লজ্জা ঘুচিবে, সাহায্য সহজলভ্য হইবে।
স্কুলছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্য লইয়া সরকার উদ্যোগী হইলে সর্বাপেক্ষা বড় লাভ— এই সমস্যাটি গণস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে গণ্য হইতে পারে। খাতায়-কলমে নহে, বাস্তবে। গণস্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে চিকিৎসার অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তাহার গুরুত্ব অপরিসীম। জীবন নামক সমুদ্রে ভাসিয়া থাকিবার কৌশলগুলি যদি ছাত্রছাত্রীদের শিখাইয়া দেওয়া যায়, তবে বহু মানসিক সমস্যা শিকড় গাড়িতে পারিবে না। স্কুলের পাঠ্যক্রমে জীবনশৈলীর পাঠ প্রবেশ করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় নাই। ফলে, বহু ক্ষেত্রেই সেই পাঠ থাকিয়া গিয়াছে নিয়মরক্ষা হিসাবে, ছাত্রছাত্রীরা তাহা হইতে লাভবান হয় নাই। মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রকৃতার্থে গণস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করিলে এই মস্ত কাজটি হইতে পারে। মন যখন গঠিত হয়, তখনই যদি তাহার জন্য বর্মের ব্যবস্থা করা যায়, ভবিষ্যতে আঘাত লাগিবার সম্ভাবনা কমে বইকি।