সম্প্রতি ভারতীয় সংসদের দুই কক্ষ— লোকসভা ও রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হল। মাননীয় রাষ্ট্রপতি সেই বিলে সইও করে দিয়েছেন। ফলে, ১৯৫৫ সালের নাগরিক বিল পাল্টে গেল। কী ছিল পূর্বের নাগরিক বিলে?
১৯৫৫ সালের যে নাগরিক আইন, তাতে ভারতের নাগরিক হওয়ার জন্য বিগত ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর এই দেশে বসবাস আবশ্যক ছিল। সেই নিয়ম শিথিল করে নতুন আইনে এই সময়সীমা করা হয়েছে ৫ বছর। পূর্বে নাগরিক আইনটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু নতুন সংশোধনে আইনটি আর ধর্মনিরপেক্ষ রইল না।
কেন?
নতুন আইনে বলা হচ্ছে, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আগত নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে তা আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নিপীড়িত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জরথুষ্ট্রবাদী, জৈন ও শিখ নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। মায়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমান, শ্রীলঙ্কার তামিল হিন্দু, তিব্বতী বৌদ্ধ, চিনের উইঘুর মুসলমান কিংবা পাকিস্তানের ইহুদি এই সুবিধা পাবেন না।
ফলে, নতুন নাগরিক আইন ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারাকে লঙ্ঘন করছে। কী আছে আর্টিকল ১৪-তে? সাম্যের অধিকার। যে কেউ, তিনি দেশি, বিদেশি, নাগরিক-অনাগরিক, এমনকি, তিনি যদি অন্য গ্রহের বাসিন্দা হন কিন্তু ভারতে বাস করেন, তিনিও সংবিধানে বর্ণিত ওই সাম্যের অধিকার ভোগ করবেন। পুনরুক্তি করে বলি, নাগরিক ও অ-নাগরিক নির্বিশেষে ওই সমান অধিকার পাবেন। এই যে সাম্য, তা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হবে না। অর্থাৎ, কেউ বেশি সুবিধা পাবেন না। সমানাধিকারের এই ধারণা নঞর্থক ধারণা। সদর্থক ধারণাটি হল, রাষ্ট্র প্রত্যেক বাসিন্দা (নাগরিক ও অ-নাগরিক)-কে একই রকম সুযোগসুবিধা দেবে। প্রথম ক্ষেত্রে অর্থাৎ নঞর্থক প্রতীতিতে ল বা ‘আইন’ হল জাতিগত ধারণা বা জেনেরিক আইডিয়া। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ সদর্থক ক্ষেত্রে ‘আইন’ হল, বিশেষ ধারণা। আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে যদি কোনও মুসলমান বা ইহুদি ভারতে আসেন ও বসবাস করেন, তা হলে তিনি নতুন নাগরিক আইন অনুযায়ী সমান অধিকার পাবেন না। ফলে, সংবিধানের ১৪ নং ধারা— ‘রাইট টু ইকুয়ালিটি’ বা সাম্যের অধিকার এখানে লঙ্ঘিত হল।
এই আইন তবে প্রণয়ন করা হল কেন? কেনই বা পাশ হল এমন বিল, যা ভারতীয় সংবিধানের মূল স্পিরিটকেই জোরালো ধাক্কা দিচ্ছে? সহজ উত্তর, সংখ্যাধিক্যের জোরে পাশ হল নতুন আইন। এর অন্তরঙ্গ কারণে খানিকটা পিছু হাঁটতে হবে।
নিশ্চয়ই মনে আছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সাম্প্রতিক অতীতে অসমে এনআরসি হয়েছে। এনআরসি হল ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স অব ইন্ডিয়া। অসমে এই জাতীয় নাগরিকপঞ্জির ফলে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ বেনাগরিক হয়েছেন। শোনা যায়, তাঁদের সিংহভাগ বাঙালি— হিন্দু ও মুসলমান। এই হিন্দু বাঙালি বাদ পড়ার ব্যাপারটিকে ভোটের রাজনীতিতে বড়সড় ধাক্কা ভেবে নতুন নাগরিক বিলের অবতারণা। এতে করে অসমের হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবেন কিন্তু মুসলমানেরা পাবেন না। স্পষ্টতই এটি ভয়ঙ্কর এক সাম্প্রদায়িক খেলা। সারা দেশ জুড়ে এনআরসি হবে, এমন কথা বার বার শোনা গিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে।
ধরা যাক, কোনও ভারতীয় ব্যক্তি রেললাইন বা রাস্তার ধারের ঝুপড়িতে থাকেন। তাঁর তেমন কোনও কাগজপত্র নেই, না থাকাটাই স্বাভাবিক। তাঁর বাপ-ঠাকুর্দারও কোনও নথি নেই। এখন এই ব্যক্তি কী করবেন? অসমের ক্ষেত্রে শোনা গিয়েছে, দালালরা মোটা টাকার বিনিময়ে তাঁদের কাগজপত্র করে দিয়েছেন। কিন্তু এনআরসি কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণের নথিকে বাতিল করেছে। কারওর রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড কিংবা প্যান কার্ডে নামের ভিন্ন ভিন্ন বানান, কোথাও পদবি এক রকম, অন্যত্র আর এক রকম। সে সব ক্ষেত্রেও বাতিল হয়েছে নাগরিকত্বের নথি। সমাজতত্ত্বের পড়ুয়ারা জানেন, মুসলমানের পয়সা হলে তাঁর পদবি বদলে যায়, আগে যিনি শেখ ছিলেন পরে তাঁর সামাজিক সম্মান বাড়াতে তিনি অন্য ‘উচ্চ’ পদবি ধারণ করেন। নমঃশুদ্রদের মধ্যেও এমন আছে। বহু ‘দাস’ পদবিধারী কায়স্থ পরে ‘সরকার’ পদবি গ্রহণ করেছেন। এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি। সেখানেও বাপ-দাদুর পদবির সঙ্গে নিজের পদবি না মেলার কারণে বাদ পড়েছেন বহু মানুষ। হ্যাঁ, এমনই তুচ্ছ কারণে এত বড় শাস্তি।
এখন প্রশ্ন হল, এনআরসির কথা কেন উঠছে? তার সঙ্গে সিএবি বা সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ড বিলের সম্পর্ক কোথায়? বস্তুত সিএবি ও এনআরসি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। একটি অন্যটির পরিপূরক। এনআরসির মধ্য দিয়ে সিএবি-র রূপায়ণ হতে পারে। আর তখনই দেখা যাবে আর্টিকল ১৪-র উল্লঙ্ঘন। বাঙাল-ঘটির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান নাগরিক ও অ-নাগরিকদের মধ্যে শুরু হবে বৈষম্য। ভারতীয় মুসলমানকে (পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি মুসলমানকে) লাইনে দাঁড়িয়ে প্রমাণ দিতে হবে যে, তিনি ভারতীয় নাগরিক। অন্য দিকে, বাইরের দেশ থেকে আসা একজন ইহুদি ও এক জন খ্রিস্টান নাগরিকের মধ্যেও বৈষম্য করা হবে। খ্রিস্টান যে সুবিধা পাবেন, ইহুদি তা পাবেন না। স্পষ্টতই নতুন নাগরিক বিল হল এক বৈষম্যমূলক আইন যা সংবিধানের মূল সুরের পরিপন্থী।
এখন যেটা মূল প্রশ্ন, সেটা হল নাগরিকত্ব প্রমাণ করার দায় কেন নাগরিক নিজে নেবেন? সেই দায় তো সরকারের। অনুপ্রবেশ রোখার দায়ও রাষ্ট্রের। যাঁর ভোটার কার্ড আছে, যিনি ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করেছেন, সেই নাগরিককে বেনাগরিক ঘোষণা করে পুনরায় নাগরিকত্ব প্রমাণের ফরমান যাঁরা জারি করছেন তাঁদের ‘বৈধতা’ সম্পর্কে তখন প্রশ্ন ওঠে। ‘অবৈধ’ নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে যদি ভারতবাসী অস্বীকার করে তখন কী হবে! সেই অস্বীকারের যথেষ্ট যুক্তি তো তাঁরাই সরবরাহ করেছেন।
নাগরিকত্ব লাভের মানে হল কিছু সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্তি। যাঁরা নাগরিক তাঁরা সেই সুযোগ পান, যাঁরা অ-নাগরিক তাঁরা তা পান না। নাগরিক দেশের জন্য শ্রম দেন—কেউ চাষ করে, কেউ হাতুড়ি পিটিয়ে, কেউ পড়িয়ে; বিনিময়ে তাঁরা রাষ্ট্রের থেকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-ভোটাধিকার প্রভৃতি সুযোগ পাওয়ার অধিকারী। রাষ্ট্র যখন তার নাগরিককে এই সব মৌলিক অধিকার প্রদান করতে ব্যর্থ হয় তখন সে নানা রকম ছল-চাতুরির আশ্রয় নেয়। বিশেষ এক ধর্মীয় শ্রেণি যদি রাষ্ট্রনায়কদের রাজনীতিকে অপছন্দ করে তবে তাঁদের সমস্ত মৌলিক অধিকার (ভোটাধিকারও) কেড়ে নেওয়া হল সুচতুর কৌশল। তাই শুরু হল বা বলা ভাল, বীজ পোঁতা হল— নাগরিককে বেনাগরিক ঘোষণা করার রাজনীতি, তাঁদের ধর্মের নামে বিভাজিত করার কৌশল, সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দেওয়ার প্রয়াস। উপার্জনশীল মানুষ যখন বৃদ্ধ মা-বাবার কিংবা সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হন, তখন তিনিও দায় এড়ানোর জন্য আদালতে বলতে পারেন, প্রমাণ করো তুমি আমার মা, বাবা কিংবা সন্তান!
মনে রাখা দরকার, এই দেশ যতখানি একজন হিন্দু বা বৌদ্ধর ঠিক ততখানিই মুসলমানের। যদি এই রকম ভাবা হয় যে, হিন্দু বলে ভারতে তিনি অতিরিক্ত সুবিধা পাবেন তা হলে ভারতীয় সংবিধানের খোলনলচে বদলে ফেলে তাঁকে হিন্দুরাষ্ট্র করে দিতে হয়। সেই দিন যে ক্রমশ এগিয়ে আসছে, এমন আন্দাজ অমূলক নয়। ভারতে হিন্দুর অধিকার বেশি, এ হল এক বিশেষ ধর্মকে উচ্চকোটিতে স্থাপন করার প্রয়াস, যা ইহুদি বা মুসলমান রাষ্ট্রে করা হয়েছে। আজ যদি ভারতে মুসলমানকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পর্যবসিত করা সম্ভব হয়, আগামীকাল আর্যদের-অনার্যদের উপর যে স্থান দেওয়ার প্রচেষ্টা হবে না, সে কথা কে বলতে পারে! কে অনুমান করতে পারে, সেই হিন্দুরাষ্ট্রে অব্রাহ্মণদের উপর ব্রাহ্মণবাদীদের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না?
বেলুড় বিদ্যামন্দিরের দর্শন বিভাগের প্রধান