সম্পাদক সমীপেষু: মেদিনীপুরের ছেলের ইংরেজি বলায় অপর্ণা সেন কেন অবাক হলেন বুঝলাম না

মানুষ নিজের ক্ষমতায়, চেষ্টায় উন্নতি করে এক জন বিশিষ্ট কেউ হয়ে ওঠার পরেও, তাঁকে নিজেদের এক জন বলে ভাবতে যখন সেই বিশিষ্ট শ্রেণির মানুষ কুণ্ঠা বোধ করেন, তখন তা ‘শ্রেণিগত অভিমান’ ছাড়া আর কী?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৯ ১২:১৯
Share:

—ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার ডিজিটাল-এ ‘ঘরে বাইরে আজ’ চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে (‘২০১৯-এর প্রেমের গল্প...’, ৫-১১), প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও পরিচালক অপর্ণা সেন (অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য প্রসঙ্গে) বললেন, ‘‘মেদিনীপুরের ছেলে যে ভাবে ইংরেজি বলল আমি অবাক হয়ে গিয়েছি।’’ অপর্ণা শুধু গ্ল্যামার-আইকন নন, শুধু এক অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্না চলচ্চিত্র-নির্দেশক নন, তিনি বাংলা সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। তাঁর কথাবার্তা থেকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কিছু শেখার চেষ্টা করা উচিত। বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করেই জনসাধারণ নিজেদের সমাজ, সংস্কৃতি সম্পর্কে নানা বিষয় জানে-শেখে। তা, আমরা কী শিখলাম? মেদিনীপুরের ছেলে(মেয়ে)দের ভাল ইংরেজি বলতে পারাটা একটা অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার!

Advertisement

আমি মেদিনীপুরের ছেলে নই। মেদিনীপুরের ছেলে অথবা মেয়েদের সঙ্গে বাংলার তথা ভারতের আর পাঁচটা গড়পড়তা ছেলে কিংবা মেয়েদের তফাতটা ঠিক কোথায়, তাও আমার জানা নেই। কিন্তু অনির্বাণ ভট্টাচার্যের অভিনয়ক্ষমতা সম্পর্কে আর পাঁচ জনের মতো আমিও অবহিত। অমন এক জন প্রতিভাবান অভিনেতা যে অভিনয়ের প্রয়োজনে একটি বিদেশি ভাষায় লেখা সংলাপকে নিপুণ ভাবে রপ্ত করে নেবেন, সে আর আশ্চর্য কী?

আশ্চর্য হওয়ার কারণ লুকিয়ে আছে অন্য জায়গায়। যা হঠাৎ করেই নগ্ন ভাবে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে অপর্ণা দেবীর বক্তব্যে। কলকাতার ‘আপার ক্লাস’ মানুষেরা, মহার্ঘ সব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে লেখাপড়া করা, ক্যালকাটা ক্লাব স্যাটারডে ক্লাবে ঘোরাঘুরি করা মানুষেরা, যে-ভাষায় কথা বলেন, যে-রকম সুললিত ও সযত্নলালিত সাবলীলতায় ইংরেজি বলার ক্ষমতা রাখেন, অন্য কোনও আর্থ-সামাজিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা কেউ সেই একই রকম স্বচ্ছন্দে ইংরেজি বলছেন— এটাই আসলে এক শ্রেণির মানুষের কাছে একটা অবাক করা ব্যাপার। সমস্যা হল, এই অবাক হওয়াটা শুধুমাত্র ইংরেজি বলার মধ্যে আটকে নেই। ‘উড়ে বামুনের ছেলে’ ঈশ্বরচন্দ্র আজ ‘বিদ্যাসাগর’ হয়ে গিয়েছেন বলে তাঁর মূর্তি ভাঙা-গড়া-উন্মোচন সবই এখন খবর, কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, সেই উনিশ শতকে ওই মহান ব্যক্তিকে শহর কলকাতায় নিজের ‘জায়গা’টা তৈরি করতে কী পরিমাণ ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ করতে হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন- ২০১৯-এর প্রেমের গল্প যৌনতা ছাড়া অবিশ্বাস্য: অপর্ণা সেন

হ্যাঁ, শ্রেণিসংগ্রাম। মানুষ নিজের ক্ষমতায়, চেষ্টায় উন্নতি করে এক জন বিশিষ্ট কেউ হয়ে ওঠার পরেও, তাঁকে নিজেদের এক জন বলে ভাবতে যখন সেই বিশিষ্ট শ্রেণির মানুষ কুণ্ঠা বোধ করেন, তখন তা ‘শ্রেণিগত অভিমান’ ছাড়া আর কী? আর মানুষের মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত জেগে থাকা এই ‘অভিমান’-এর সঙ্গে নানা ভাবে লাগাতার লড়ে বা জুঝে যাওয়া, এও এক শ্রেণিসংগ্রামই তো বটে।
খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এই মানসিক সমস্যা কলকাতা তথা বাংলায় সীমাবদ্ধ নয়, সর্বত্র সর্বকালে রয়েছে। মার্কিন দেশের কোনও এক উত্তর-পূর্ব প্রদেশের এক ছোট্ট শহরে এক পাকিস্তানি ভদ্রলোক একটি ভোজনালয় খুলেছিলেন। আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগের কথা। অবসর সময়ে তাঁর দোকানে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করতাম। এক দিন প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি তো এক কালে আবু ধাবি না কোথায় থাকতেন। সেখানে ভাল চাকরিও করতেন। সে সব ছেড়েছুড়ে বেশি বয়সে আবার এই কষ্টের, খাটাখাটনির জীবন বেছে নিলেন কেন? উত্তরে উনি বলেছিলেন, এক জন মুসলমান হিসেবে ওঁর ধারণা ছিল, আরব দুনিয়ায় উনি সসম্মানে জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকতে থাকতে ওঁর ভুল ভেঙে যায়। বহু আরবি মানুষের মনেই ভিন্‌দেশীয় মুসলমান সম্পর্কে কণামাত্র সম্মান বা ভ্রাতৃত্ববোধ নেই।

জার্মানিতে অতীতে চর্মকারের বৃত্তিতে নিযুক্ত ছিল এমন পরিবারের ছেলেমেয়ে (Schuhmacher), অথবা অতীতে দর্জিবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করা পরিবারের ছেলেমেয়ে (Schneider)-দের তারকা হয়ে উঠতে এতটা সামাজিক ‘চড়াই’ পেরোতে হয় না, কারণ ওই দেশে ওই সমাজে বর্ণ (caste)-এর ভূত ভর করেনি। যদিও সেখানে গণ-ইহুদি-নিধন হয়েছে। মার্কিন মুলুকের ইতিহাস ও সংবিধান দুই-ই পরিশ্রমকে মূল্য দেয়। তাই হয়তো সেখানে যে কেউ নিজের মেধা ও পরিশ্রমের দ্বারা নিজের অবস্থার উন্নতি ঘটালে, তার পক্ষে এক আর্থ-সামাজিক শ্রেণি থেকে উচ্চতর আর্থ-সামাজিক শ্রেণিতে ঢুকে পড়াটা খুব কঠিন হয় না। অবশ্যই সাদা ও কালো চামড়ার সংঘাত সেখানে আছে ও আরও বহু কাল থাকবে। কিন্তু ভারতের মতো বর্ণ-শিক্ষা-অর্থ-ধর্ম-সম্প্রদায়-প্রদেশ সমস্ত বিষয়ে এমন নানাবিধ শ্রেণিবিভাজন আর কোনও দেশে আছে বলে জানা নেই।

আমার এক পরিচিত আমাকে মাঝে মাঝেই বলে, কম্পিউটারে সমস্যা দেখা দিলে যখন আর কোনও পদ্ধতিই কাজ করে না, তখন যেমন system reboot-ই একমাত্র উপায়, তেমন ভারতের সমস্যাগুলো সব মিলিয়ে যেখানে পৌঁছেছে, ওই রকম system reboot গোছের কিছু একটা করতে পারলে ভাল হত। হয়তো অনেক ভারতবাসীই ওই রিবুট-এর চাবিটাই খুঁজছেন।

সুদীপ্ত ভট্টাচার্য
লেক ব্লাফ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement