ফাইল চিত্র।
বাজারে দেখা ভদ্রলোকের সঙ্গে। অল্প চাষের জমি আছে, নিজেই সবজি চাষ করেন, বাজারে বসে বিক্রি করেন। প্রশ্ন করলেন, এই যে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন হল, কৃষি বিল পাশ হল, এতে কি আমাদের মতো প্রান্তিক চাষিদের সত্যি লাভ হবে?
বললাম, আপনার কী মনে হয়? ভদ্রলোক বললেন, এ বছর আলু-পেঁয়াজ যা চাষ করেছিলাম, মহাজনের দেনা মেটাতে চৈত্র মাসেই সব বিক্রি করে দিয়েছি। তখন আলুর দর ছিল দশ টাকা কেজি, পেঁয়াজ ন’টাকা। গত সপ্তাহে চল্লিশ টাকা কেজি পটল বেচে আটত্রিশ করে আলু কিনেছি, ছত্রিশ টাকায় পেঁয়াজ। আমাদের তো খেতের ফসল মজুত করার ক্ষমতা নেই! তাঁকে বললাম, এখন তো আর গ্রামের মহাজনের কাছে টাকা ধার করতে হবে না। নানা কর্পোরেট সংস্থা চুক্তি চাষের জন্যে অগ্রিম টাকা দেবে, ফসলও তারাই কিনে নেবে। আপনি ইচ্ছে করলে দেশের যে কোনও জায়গায় ফসল ন্যায্য দামে বিক্রিও করতে পারবেন।
ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। বললেন, আপনার কি ধারণা কর্পোরেট সংস্থাগুলো সমাজসেবা করতে আসবে? তাদের হয়ে দেশের সেরা উকিল-ব্যারিস্টার চুক্তির শর্ত তৈরি করবে। চাষিদের পক্ষে সেই চুক্তির শর্তের খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখা সম্ভব?
করোনা পরিস্থিতিতে সংসদের বাদল অধিবেশনে সময়সীমা কমানো, প্রশ্নোত্তর পর্ব বর্জন-সহ যে-সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তা নিয়ে বিরোধীরা আগেই সরব হয়েছিলেন। তার মধ্যেই পাশ হয়ে গেল একগুচ্ছ বিল। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক বেধেছে কৃষি বিল এবং ১৯৫৫ সালের অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন নিয়ে। সরকারের দাবি, নতুন আইন কার্যকর হলে কৃষকরা তো বটেই, উপকৃত হবেন সাধারণ মানুষও। কিন্তু ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক থেকে শুরু করে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ এই আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছেন না। তাঁদের সংশয় আরও ঘনীভূত হয়েছে, কেন্দ্রে বিজেপির শরিক শিরোমণি অকালি দলের সাংসদ তথা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দফতরের পূর্ণমন্ত্রী হরসিমরত কৌর বাদল কৃষি বিলের বিরোধিতা করে পদত্যাগ করায়। বিরোধীদের আশঙ্কা, এক দিকে কৃষি বিল আইনে পরিণত হলে যেমন কৃষকের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে, অন্য দিকে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধনে বিপদে পড়বেন সাধারণ গ্রাহক। কারণ, যে কৃষকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে বলে দাবি, আমাদের দেশ তথা রাজ্যে তাঁদের সংখ্যা নগণ্য। পঞ্জাব, হরিয়ানা-সহ দু’একটা রাজ্যের কথা বাদ দিলে দেশের সিংহভাগ কৃষকই ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক। তাঁদের পক্ষে বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে দর কষাকষি করে নিজেদের শর্তে লাভজনক চুক্তি করা, প্রতিযোগিতামূলক দামে দেশের যে কোনও প্রান্তে ফসল বিক্রি বা মজুতদারির উপর থেকে উঠে যাওয়া নিয়ন্ত্রণের সুফল লাভ করা অলীক কল্পনা মাত্র।
এত কাল অবশ্য অত্যাবশ্যক পণ্য আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও খাদ্যশস্য, খাদ্যবীজ, তৈলবীজ, পেঁয়াজ, আলু ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সীমা-বহির্ভূত মজুত পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এই বেআইনি কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত বলে চিহ্নিত, দু’একটা ব্যতিক্রম বাদে তাদের সকলেই মূলত ফড়ে, দালাল বা মহাজন। কৃত্রিম ভাবে জোগানে রাশ টেনে এত কাল তারা অনৈতিক মুনাফা করে এসেছে।
এই অতীত-অভিজ্ঞতাই সাধারণ মানুষের আশঙ্কা দৃঢ় করছে। কারণ, সংশোধিত অত্যাবশ্যক পণ্য আইন অনুসারে নিত্যপ্রয়োজনীয় যে সব ভোজ্যসামগ্রীকে ‘অত্যাবশ্যক’ তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সীমাহীন মজুতের ছাড়পত্র দেওয়া হল, সেগুলির মধ্যে পচনশীল খাদ্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে দাম দ্বিগুণ এবং পচনশীল নয় এমন সামগ্রীর ক্ষেত্রে দাম দেড় গুণ না হওয়া পর্যন্ত সরকার হস্তক্ষেপ করবে না। অনেকেরই মত, অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধনের মাধ্যমে কার্যত ওই নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যথেচ্ছ মজুত করা এবং কৃত্রিম ভাবে জোগান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করাটা আইনসিদ্ধ হয়ে গেল!
এমন সুবিধাজনক আইনি পরিমণ্ডলে ভারতের অঢেল কৃষিজ উৎপাদন ও বিপুল গ্রাহক যে বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থাকে আকৃষ্ট করবে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে অমিত ক্ষমতাশালী এই সব নবোদিত কৃষিপ্রেমী সংস্থার হাতে কৃষকের অধিকার ও স্বার্থ কতটা অক্ষুণ্ণ থাকবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ। একচেটিয়া বাজার দখলের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান ও দামের নিয়ন্ত্রণ-রজ্জুটি তাদের কুক্ষিগত হতে পারে, সে আশঙ্কাও অমূলক নয়।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে অবিভক্ত বাংলার প্রায় এক কোটি, পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলা ও ওড়িশা মিলিয়ে প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিলেন। দুই ক্ষেত্রেই লাগামহীন মজুত, কালোবাজারির ফলে আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি ও তা নিয়ন্ত্রণে শাসকের নিষ্ক্রিয়তা দায়ী ছিল। এই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না। কৃষি বিল বা সংশোধিত অত্যাবশ্যক পণ্য আইন নিয়ে মানুষের মনে যে সংশয় ও ভয় জেগেছে, তা নির্মূল করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। মানুষ সে দিকেই তাকিয়ে আছেন।