ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গই ভারতে প্রথম রাজ্য, যাহা শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে আইন পাশ করে। ১৯৯৬ সালে, বিচারক ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার রায়ে বলেন, বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিসরে, শ্রবণ না করিবার স্বাধীনতা এবং/অথবা নীরব থাকিবার স্বাধীনতা আবশ্যিক ভাবে অন্তর্ভুক্ত। দেশে সেই প্রথম রাত্রি নয়টা হইতে সকাল সাতটা পর্যন্ত মাইক্রোফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ হইয়াছিল। রায়টি মাইলফলক হইয়া আছে। এবং অধিকাংশ মাইলফলকের ন্যায়ই, আজ তাহা গুল্মাচ্ছাদিত ও বিস্মৃত। কালীপূজায় শব্দ লইয়া চাপান-উতোরে এমন দর্পিত মতও শুনা যাইতেছে, সারা বৎসর এত দূষণ হইতেছে, এই দুই দিনে তাহা এমন কী আর বৃদ্ধি পাইবে? ইহা অবশ্য যুক্তি নহে, অন্যায়ের অজুহাত। অন্য দিনও অন্যায় হয় বলিয়া অদ্য অন্যায় করিবার অধিকার জন্মায় না। পশ্চিমবঙ্গ যে এমন একটি পরিণত ও দূরদর্শী রায় দিয়াছিল, তাহা লইয়া এই রাজ্য তত্ত্বগত গর্ব করিতে পারে, কিন্তু রাজ্যবাসীরা ওই রায়ের নির্যাস বুঝিতে সক্ষম, তাহা কালীপূজার অতিশব্দ সন্ধ্যায় মনে হয় না। ওই শব্দ চিন্তা করিবার অধিকারকে, নীরবতা-পরিবৃত থাকিবার অধিকারকে কাড়িয়া লয়। চিন্তা করিবার জন্য আত্ম-অবগাহন প্রয়োজন। এই রাজ্যে তাহার উপায় নাই, সর্ব ক্ষণই অন্য শব্দের উপদ্রব আসিয়া নিজ ভাবনাস্রোতের ধ্বনি ঢাকিয়া দিতেছে। নিৎশে বলিয়াছিলেন, সকল মহান ভাবনার উদয় হয় হাঁটিবার সময়। ভাগ্যে তিনি কলিকাতার রাস্তায় হাঁটেন নাই। উৎসবে ডিজের দাপট দেখিলে অবশ্য তিনি বসিয়া বা শুইয়াও দর্শন ভাবিয়া পাইতেন না। শব্দদূষণ কেবল শ্রবণশক্তিকেই বিঘ্নিত করে না, স্নায়ুকে পীড়িত করে, স্বভাবকে উগ্র ও বিরক্তিময় করিয়া তুলে, নিদ্রাও বিঘ্নিত হয়। অবাঞ্ছিত ও চিত্তবিক্ষেপকারী শব্দ আসিয়া মানসিক শান্তিকে তছনছ করিয়া দেয়। যখন পাড়ায় মধ্যরাতে ধর্ম বা জলসা চলিতে থাকে (উভয়ের রূপ খুবই সদৃশ, প্রবল তালযুক্ত সঙ্গীত ও কোমর ছটকাইয়া নৃত্য ইদানীং প্রায় প্রতিটি ধর্ম পালনের অঙ্গ) তখন অসহায় নাগরিকের কেবল শারীরিক কষ্ট হয় না, হৃদয়ে প্রবল আক্রোশ ঢুকিয়া পড়ে, যাহা হয়তো অন্যত্র পথ খুঁজিয়া লয়। অনেকেই বলিয়াছেন, মানুষের ক্রমবর্ধমান হিংসার নেপথ্যে হয়তো একটি কারণ শব্দদূষণ। কালীঠাকুর মুণ্ডমালাশোভিতা, কিন্তু তাঁহার পূজায় হিংস্রতা উদ্যাপন করিতে হইবে কেন? অবশ্য আমাদের দেশে ধর্ম পালনের মধ্যে অধিকাংশ সময়েই মিশ্রিত থাকে উগ্রতা, দাপট ও অসহিষ্ণুতা। ধর্মীয় মিছিল যাইলে নাগরিকের চলিবার অধিকার এক কোণে দাঁড়াইয়া মিনমিন করে। ধর্মস্থান হইতে মাইকে স্তব প্রচারের কালে কাহারও না-শুনিবার অধিকারের কথা ধর্তব্যে আনা হয় না। ধর্মীয় উৎসবের সময় যে কোনও রাস্তা বন্ধ করিয়া মণ্ডপ নির্মাণ করা চলে। ধর্মকে কেহ আঘাত করিলে রইরই পড়িয়া যায়, ধর্ম সততই অন্যকে অাঘাত করিতে পারে, তাহা লইয়া কোনও হেলদোল নাই। সেই ধর্মের অঙ্গ হিসাবে বাজি ফাটানো চলিতেছে, ইহা তো মৌলিক অধিকার!
এইখানেই ভগবতীবাবুর রায়টির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝিতে হইবে। বলা হইতেছে, বাক্স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত উপাদান হইল, বাক্য না বলিবার বা না শুনিবার স্বাধীনতা। এই নিত্য কলরবময় দেশে ইহা অধিকাংশ মানুষ অনুধাবনই করিতে পারিবে না। এখানে অটোয় গান বাজিতেছে, মেট্রো স্টেশনে টিভি চলিতেছে, শপিং মল-এ বাজনা ধ্বনিত, রাস্তায় গগনবিদারী হর্ন, জলসার গান মাইকে বহুবর্ধিত, জনসভার বক্তৃতা প্রত্যেকের কর্ণকুহরে পৌঁছাইবার চেষ্টা চলিতেছে, মোবাইলের কথোপকথন গোটা ট্রেনের কামরা শুনিতে বাধ্য হইতেছে। যাঁহারা বলিতে উদ্গ্রীব, তাঁহাদের মত: আমার যদি বলিবার অধিকার থাকে, অন্যের তবে না শুনিবার অধিকার আসে কোথা হইতে? এইখানেই পরিমিতিবোধের ভূমিকা, আত্মসংবরণের তাৎপর্য। সভ্যতার মূল সূত্র হইল, এই দৃষ্টি নিজের প্রতি জাগ্রত রাখা, আমার জন্য যেন অন্যের না অসুবিধা ঘটে। কথা বলিবার সময়ে যদি বিস্মৃত হই, অন্য মানুষটি না শুনিতে চাহিতে পারে, তবে সৌজন্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়। ভগবতীপ্রসাদ ইহাও বলিয়াছিলেন, অন্যের অধিকারের মূল্যে এবং অন্যকে অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া কেহ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে পারে না। ইহাই অমোঘ বাক্য। নিজের অধিকার প্রয়োগ করিবার কালে অন্যের অধিকার স্মরণে না রাখিলে, তাহা আত্মপ্রকাশ নহে, আগ্রাসন। কেবল আত্মময় হইয়া সমাজে ব্যবহার করিলে, তাহা স্বাধীনাচরণ নহে, মস্তানি।
পুজোর সময় বৃষ্টি পড়লে সমস্ত মাটি। এত প্রযুক্তিগত উন্নতি হচ্ছে, আর কলকাতাকে ত্রিপল দিয়ে মুড়ে একটা ‘ইন্ডোর শহর’ করা যাচ্ছে না? এমনিতেই তো আকাশ খুব দেখা যায় না, উড়াল পুল, উঁচু বাড়ি আর হোর্ডিং-এ সব আড়াল। এ বার টানা ফাইবার গ্লাসের ছাদ হোক, নীচে নিয়ন আলো, এলইডি, ত্রিফলা। অনেক নিরাপদ পরিপাটি শহর হবে, আনন্দ-পরবেও নিশ্চিন্দি। পরিবেশওয়ালাদের ভ্রুকুটি? কয়েকটা প্লাস্টিকের গাছ আর রিমোট কন্ট্রোল্ড পাখি ছেড়ে দিলেই মিটে গেল।