দেশ জুড়ে সাম্প্রতিক জলের জন্য হাহাকার দেখে ‘দ্য লাইফলাইন’ নামে একটি তথ্যচিত্রের কথা মনে পড়ে গেল। তাতে এমন এক সময়ের কথা দেখানো হয়েছিল, যখন সব দিকে জলের জন্য হাহাকার, বন্দুকধারী প্রহরীরা রাজনীতিকদের বাদ দিয়ে জলাশয়গুলিকে রক্ষা করছে যাতে কেউ বরাদ্দ রেশনের বেশি জল না নিতে পারে। জলের অভাবে মারা যাচ্ছে শিশুরা। মানুষকে কেমন অন্য গ্রহের জীবের মতো দেখতে লাগছে! আজকের দেশের জলসঙ্কটের ছবি যেন তাই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে যে, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’।
ইতিমধ্যে শোনা গেল প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ‘মন কি বাত’ এবং মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভার বক্তৃতা। তাঁরা মূলত সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে বলছেন, জলের অপচয় না করতে বলছেন। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারও মনে করিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের দায়িত্ব। হক কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষ রাতারাতি জল সংরক্ষণে সচেতন হয়ে উঠলেই এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে তো?
স্পষ্ট করে বলা দরকার: না! রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা জলসম্পদ নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা না করলে, ঘুম ভেঙে না উঠলে, জল নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দুর্নীতিতে মদত দেওয়া বন্ধ না করলে জনসচেতনতা দিয়ে খুব বেশি দূর যাওয়া যাবে না।
বাকি দেশের কথা ছেড়ে দিয়ে আমাদের রাজ্যে আসা যাক। প্রয়াত জলাভূমি-বিশেষজ্ঞ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ একটা কথা বলতেন যে, কলকাতা হল একটি ‘ইকোলজিকালি সাবসিডাইজ়ড’ শহর, অর্থাৎ প্রকৃতির প্রচুর দাক্ষিণ্য কলকাতার ওপর বর্ষিত হয়েছে; বিশেষত জলসম্পদের ক্ষেত্রে। এই শহরের পশ্চিমে হুগলি নদী, তা থেকে আমাদের পানীয় জলের জোগান আসে। পুবে বিশাল জলাভূমি, যেখানে শহরের ময়লা জল শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোধনই হয় না, এই জল ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণে মাছ চাষ হয়, শাকসবজির উৎপাদন হয়, যা কলকাতায় বেঁচে থাকার গড়পড়তা খরচকে দেশের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় কম রাখে। এ ছাড়াও এই শহরের মাটির তলায় ঐতিহাসিক ভাবে জল ছিল প্রচুর, কেননা এই গোটা অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ হিসেবে। পলিমাটির কারণে মাটির তলায় বিপুল পরিমাণ জল প্রবেশ করতে পারে ও মাটির তলার জলসম্পদকে বাড়িয়ে রাখতে পারে। বস্তুত, কলকাতাকে ব্রিটিশ আমলে ‘সিটি অব পন্ডস’ বলা হত— এত অজস্র ছোট বড় পুকুর ও জলাশয় ছিল এই শহরে। এমনকি সাম্প্রতিক ‘ন্যাশনাল অ্যাটলাস অ্যান্ড থিম্যাটিক ম্যাপিং অর্গানাইজ়েশন’ বা ন্যাটমো’র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, কয়েক দশক আগেও এই শহরে ৮৭০০-র বেশি জলাশয় ছিল, যার চল্লিশ শতাংশ গত দু’তিন দশকের মধ্যে ভরাট হয়ে গিয়েছে। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহুতল উঠেছে একের পর এক জলাশয় ভরাট করে। একে জলা ভরাট, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোটা শহরকে কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া— এই যুগলবন্দিতে যে ক্রমেই মাটির তলায় জল যাওয়া কমছে, তা বুঝতে বিজ্ঞানী হতে হয় না। রাজ্যের ছবিটাও কম বেশি একই রকম।
পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বুজিয়ে উড়ালপুল প্রস্তাবিত হল, রাজারহাটের বিস্তীর্ণ জলাভূমি বন্ধ করে নতুন কলকাতা তৈরি হল (মনে রাখতে হবে ওই অঞ্চলটি ছিল কলকাতার মাটির তলার জল রি-চার্জের অন্যতম স্থান), এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক মদতে সুবিধাভোগী মানুষের নানান অপকীর্তির জেরে রাজ্যের প্রায় ৭০টি নদী হারিয়ে গেল, বর্ষা বাদ দিয়ে অন্য সময় অধিকাংশ নদী চাষের জমিতে পরিণত হল, আদি গঙ্গা বা সরস্বতী নদীর মতো ঐতিহাসিক নদীগুলি স্রেফ নর্দমায় পর্যবসিত হল, উত্তর চব্বিশ পরগনায় কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের দু’পাশের বিশাল বিলকান্দা জলাভূমি চোখের সামনে স্রেফ ‘নেই’ হয়ে গেল, সরকার ভোটের রাজনীতিকে সামনে রেখে জল ব্যবহারের ওপর কর বসাল না, বরং চাষিদের জন্য মাটির তলার জল তোলার আইনটি শিথিল করল। প্রশ্নটা ঠিক এখানেই। গোটা দেশ জুড়েই এত বছর ধরে রাজনীতিক নেতা-নেত্রী ও তাঁদের বশংবদ চেলাদের সহায়তায় বড় শিল্পপতি থেকে পাড়ার প্রোমোটাররা জলা বুজিয়ে বহুতল বানিয়েছেন; নদীকে কোথাও চোলাই মদ তৈরির কারখানা, কোথাও বা নর্দমা, আবার কোথাও স্রেফ বুজিয়ে দিয়েছেন, মাটির তলার জল ইচ্ছেমতো তুলে নিয়েছেন, আর আজ জলসঙ্কট গলা চেপে ধরলে শুধু জনগণের সচেতনতাই দরকার? আজকের এই পরিস্থিতির সম্পূর্ণ দায় দেশের রাজনীতিক ও প্রশাসকদের— দায়িত্বও তাঁদেরই নিতে হবে।
আজকাল পৃথিবী জুড়ে ‘পলিটিকাল রেন্ট-সিকিং’ নামে অর্থনীতির একটি তত্ত্ব আলোচিত হচ্ছে, যার অর্থ— কেমন ভাবে রাজনীতিক নেতারা অসাধু নিয়মভঙ্গকারীদের আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে নিজেদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছেন। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। জনসচেতনতা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তা তখনই আসবে, যখন মানুষ দেখবেন সরকার নিজে জলসম্পদ বাঁচাতে সৎ ও আগ্রহী। এক দিকে জলা ভরাটে মদত দিয়ে অন্য দিকে জনমানসের সচেতনতা নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া, দুটো পাশাপাশি চলতে পারে না। কাটমানি ফেরতের মতো এটাও বোধ হয় বলার সময় হয়েছে যে, আমাদের জলাশয়, জলাভূমি ফেরত দাও।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সব সমস্যা তো আগেও ছিল; তা হলে হঠাৎ করে এ বছর এত খারাপ অবস্থা কেন? প্রথমত, ঘড়ার জল একেবারে কমে না আসলে তা টের পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্ষা আসার সময়কাল বেশ খানিক পিছিয়ে গিয়েছে, জলের অভাবটা আরও বেশি টের পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরও ফরাক্কার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বেশ কয়েক দিন বিদ্যুৎ তৈরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যথেষ্ট জলের অভাবে। বিজ্ঞানীদের এত সাবধানবাণী থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি সামলানোর কোনও পরিকল্পনা না করাটাও কি সরকারের ব্যর্থতার মধ্যে পড়ে না?