এক বৎসরে পাঁচটি রাজ্যে শাসনক্ষমতা হারাইল বিজেপি। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রের পর সেই তালিকায় সাম্প্রতিকতম নামটি ঝাড়খণ্ডের। কংগ্রেস-ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা-আরজেডি জোটের নিকট ধরাশায়ী বিজেপি। ইহার কারণ একাধিক। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার প্রবণতা যদি একটি কারণ হয়, ঝাড়খণ্ডের ন্যায় রাজ্যে জনজাতির প্রশ্নটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়ার যে অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে উঠিতেছে— সদ্যপ্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস কার্যত যে প্রবণতাটির প্রতীক হইয়া উঠিয়াছিলেন— তাহাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ কারণ। জামশেদপুর পূর্ব কেন্দ্রে বিজেপির বিক্ষুব্ধ নেতা, নির্দল প্রার্থী সরযূ রায়ের বিরুদ্ধে রঘুবর দাসের পরাজয় বলিতেছে, তাঁহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ রায় তুলিয়াছিলেন, মানুষ তাহাকেও গুরুত্ব দিয়াছে। ঝাড়খণ্ডের ন্যায় দরিদ্র রাজ্যে কর্মসংস্থান, জনজাতি উন্নয়ন ইত্যাদি প্রশ্নের রাজনৈতিক গুরুত্ব মাপিতে বিজেপি ভুল করিয়াছিল কি না, সেই প্রশ্ন উঠিতে পারে। নির্বাচনের ফলাফলকে সাক্ষী মানিলে বলিতে হয়, রাজ্যের মানুষ ‘জল, জঙ্গল, জমিন’-এর আদি প্রশ্নগুলিকেই মাপকাঠি করিয়াছেন। বিজেপি তাহাতে পাশ করে নাই।
রাজ্যের অভ্যন্তরীণ প্রশ্নগুলির ঊর্ধ্বে উঠিয়া, গত এক বৎসরে বিভিন্ন বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে, যদি ঝাড়খণ্ডের ফলাফলকে বিচার করা হয়, তবে একটি বৃহত্তর ছবি ফুটিয়া উঠে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিজেপি রাজ্যস্তরের রাজনৈতিক প্রশ্নগুলিকে অবহেলা করিয়া জাতীয় প্রশ্নে নির্বাচন লড়িয়াছিল। অর্থাৎ, বিজেপির নিকট লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচনে ফারাক নাই— তাহাদের কাছে প্রতিটি নির্বাচনই নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে বা বিপক্ষে গণভোট। গত ডিসেম্বরে তিন রাজ্যে পরাজয়ের পর এই বৎসর মে মাসে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয়, এবং তাহার পর মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে পরাজয়, হরিয়ানায় কোনও ক্রমে ক্ষমতা ধরিয়া রাখা— ঘটনাগুলিকে যথাক্রমে সাজাইয়া দেখিলে বোঝা সম্ভব, দেশের মানুষ বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনের মধ্যে ফারাক করিতে জানেন। লোকসভায় যদি তাঁহারা নরেন্দ্র মোদীকে চাহেনও, বিধানসভায় শুধু তাঁহাকে দেখিয়াই ভোট দিতে নারাজ। গণতন্ত্রের পক্ষে ইহা সুসংবাদ। বিধানসভা নির্বাচন সর্বার্থেই রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্ন। কেন্দ্রীয় নেতার ছাতির মাপে যে রাজ্যের নিজস্ব প্রশ্নগুলির ইতরবিশেষ হয় না, ভারতীয় ভোটার এই কথাটি জানেন, এবং বুঝাইয়া দিতে পিছপা নহেন। ঝাড়খণ্ডেও তাহা স্পষ্ট— নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের জনসভা, তাহাতে গরম গরম ভাষণের পরও বিজেপির ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হয় নাই।
শুধু সর্বভারতীয় নেতৃত্ব লইয়া নহে, প্রশ্ন সর্বভারতীয় প্রসঙ্গ লইয়াও। রাজ্য জুড়িয়া বিজেপি যখন কাশ্মীর, পাকিস্তান আর এনআরসি-র গল্পগাছা শুনাইয়াছে, জেএমএম-কংগ্রেস তখন তাহাদের প্রচারে রাজ্যের অনুন্নয়নের প্রসঙ্গটিকে হারাইতে দেয় নাই। ভোটাররা বুঝাইয়া দিয়াছেন, তাঁহাদের আগ্রহ কোন দিকে। দেশ বলিতে যে শুধুমাত্র কাঁটাতার বোঝায় না— বহু ক্ষেত্রেই দেশ মানে যে শুধু ঘর হইতে দুই পা ফেলিবার দূরত্ব, আহার-অনাহারের প্রশ্ন, অরণ্যের অধিকারের প্রশ্ন, কর্মসংস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের প্রশ্ন— এবং, এই প্রশ্নগুলির সদুত্তর জোগাইতে না পারিলে মানুষের নিকট সামরিক কুচকাওয়াজের জাতীয়তাবাদ নেহাত অর্থহীন বুলি হইয়া দাঁড়ায়, কথাটি রাজনীতি যত দ্রুত বোঝে, ততই মঙ্গল। মহারাষ্ট্রের আখচাষিদের ক্ষোভের সহিত ঝাড়খণ্ডের জনজাতিভুক্ত মানুষের অপ্রাপ্তির বহু ফারাক রহিয়াছে। মিল একটিই— পাকিস্তান বা হিন্দু রাষ্ট্র বা রাম মন্দির, এই সবের বাহিরে তাঁহাদের একটি বাস্তব জীবন আছে, পেট চালাইবার, সম্মান লইয়া বাঁচিবার প্রয়োজন আছে। এই ভোটের ফলাফল সেই কথা মনে করাইতেছে।