যে কট্টর ট্রাম্প-সমর্থকেরা ক্যাপিটল হিল লন্ডভন্ড করলেন, তাঁরা আমেরিকার সমাজের ‘তৃতীয় পক্ষ’ কি না, অথবা ঘটনাটি সে দেশের গণতন্ত্রের উপর কতখানি আঘাত, সে নিয়ে কাটাছেঁড়া চলতেই থাকবে। বরং ট্রাম্পের শাসনকাল আমেরিকান গণতন্ত্রের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ, না কি গণতন্ত্রেরই শক্তির প্রকাশ, সেই আলোচনা জরুরি।
ভোট ফুরোলেও ট্রাম্পের ঐতিহ্য আমেরিকার শোণিতস্রোতে প্রবাহিত হবে দীর্ঘ দিন। এ বারও প্রায় ৪৭ শতাংশ ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে, যাঁদের সিংহভাগ নিশ্চয়ই আক্রমণের সঙ্গে সহমত নন। তবে এ-ও ঠিক যে, ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি’ নিয়ে লোফালুফির ইতিহাস জেনেই ভোট দিয়েছেন তাঁরা।
চার বছরেই পৃথিবী জুড়ে শোরগোল ফেলেছেন ট্রাম্প। ২০১৭-য় দায়িত্ব নেওয়ার পরে অভিবাসনে নিষেধাজ্ঞা, তার পর মেক্সিকোর সীমানায় দেওয়াল তোলা, ক্ষমতায় বসার পাঁচ মাসের মধ্যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসা, বর্ষপূর্তির আগেই একপেশে সিদ্ধান্তে জেরুসালেমকে ইজ়রায়েলের রাজধানী ঘোষণা করা, রাষ্ট্রপুঞ্জের ১২০টিরও বেশি দেশ তার প্রতিবাদ করলে রাষ্ট্রপুঞ্জেরই অনুদানে কাটছাঁট করা, অতিমারির মধ্যেও হু-এর অনুদান বন্ধের হুমকি— আমেরিকার বিশ্ব-নেতৃত্বের জায়গাটাই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। কিম জং-উন’এর সঙ্গে বিস্তর তরজার পরে সিঙ্গাপুর আর হ্যানয়তে আলোচনায় বসাও ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কারের তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ বলেই মনে করেন অনেকে।
তবে, ট্রাম্প কিন্তু ‘ফেক নিউজ়’ আর ‘পোস্ট ট্রুথ’ জগতের স্রষ্টা নন, তাঁর হাতে তার সমৃদ্ধি ঘটেছে মাত্র। মনোবিদ তথা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাইঝি মেরি-র বিতর্কিত বই টু মাচ অ্যান্ড নেভার এনাফ: হাউ মাই ফ্যামিলি ক্রিয়েটেড দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ডেঞ্জারাস ম্যান (২০২০) বর্ণনা করেছে, কী ভাবে ট্রাম্প পরিবার, বিশেষ করে ডোনাল্ডের বাবা ফ্রেড ট্রাম্প সিনিয়র তৈরি করেছেন বিশ্বের ভয়ানকতম মানুষটিকে! মেরি লিখছেন, “ডোনাল্ডের প্রয়োজন বিভাজন। এটাই তাঁর বাঁচার একমাত্র পথ।” তবুও মনে রাখতে হবে, আমেরিকান গণতন্ত্রই কিন্তু তিলে তিলে মূর্ত করেছে আজকের ট্রাম্পকে।
ট্রাম্প কি তবে গণতন্ত্রের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন? না। গণতন্ত্রই তাঁর রাশ টেনেছে। সে দেশের জনতা, সেলেব্রিটিরা নিয়মিত তাঁকে বিঁধতে ছাড়েননি। এইচ-১বি ভিসার সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া কিংবা অভিবাসন— নানা সময়ে আদালত নিয়ন্ত্রণ করেছে তাঁকে। অতিমারির মধ্যেও ট্রাম্প অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে চেয়েছিলেন, পুনর্নির্বাচনের স্বার্থেই। এপ্রিলের মাঝামাঝি তিনি দাবি করেন, কখন কী ভাবে লকডাউন শিথিল হবে, তা ঠিক করার ‘সার্বিক ক্ষমতা’ প্রেসিডেন্টের, গভর্নরদের অগ্রাহ্য করেই! এক দিনের মধ্যেই তাঁকে পিছু হটতে হয়। সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা উপদেষ্টারা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন নিশ্চয়ই। নির্বাচন পিছোতেও আগ্রহী ছিলেন তিনি, কিন্তু সংবিধানের বাঁধন এতই আঁটসাঁট যে, এ ছিল তাঁর ক্ষমতার বাইরে।
বস্তুত, আমেরিকার গণতন্ত্রের সুদৃঢ় রক্ষাকবচ না থাকলে ট্রাম্পের মধ্যে শি চিনফিং, ভ্লাদিমির পুতিন বা রিচেপ তায়িপ এর্দোয়ান হয়ে ওঠার মশলা পুরোদস্তুর ছিল। ১৮ বছর একচ্ছত্র ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৮-য় রুশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের পুনর্নির্বাচনে উচ্ছ্বসিত ট্রাম্প তাঁকে অভিনন্দন জানান। এতে প্রকাশ্যেই বিরক্তি ব্যক্ত করেন রিপাবলিকান নেতা জন ম্যাকেন। শি চিনফিং আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট থাকার ব্যবস্থা পাকা করে ফেললে উজ্জীবিত ট্রাম্প কখনও আমেরিকাতেও সেই ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করেন। বেচারা ট্রাম্প! তিনি ‘ভুল’ দেশে, ‘ভুল’ সময়ে জন্মেছেন, প্রেসিডেন্ট হয়েছেন ‘ভুল’ সমাজব্যবস্থায়। অন্য কোনও দেশের মতো জনপ্রতিনিধি কেনাবেচার চেষ্টাও আইনসিদ্ধ ভাবে চলে না তাঁর দেশে।
ক্ষমতার হস্তান্তরের সময়ে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের উপস্থিত থাকাটা শিষ্টাচার। জনমানসে বার্তা যায়, ‘দেশ’ ব্যক্তিগত জয়-পরাজয়ের ঊর্ধ্বে। বাইডেনের শপথগ্রহণে থাকলেন না তিনি, আমেরিকান গণতন্ত্রের কাঠামোয় আঘাত করলেন ট্রাম্প। নতুন প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণে ‘পরাজিত’ বিদায়ী প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি শেষ বার ঘটে ১৫২ বছর আগে। সে বারের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনও তার বছর খানেক আগে ‘ইমপিচড’ হয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে এক রূপকথার শপথের ইতিবৃত্ত ফিরে দেখা যেতে পারে। ১৯৬১-তে কেনেডির শপথগ্রহণে তাঁর আমন্ত্রণেই উপস্থিত ছিলেন ৮৬ বছরের বৃদ্ধ কবি রবার্ট ফ্রস্ট। ক্যাপিটল হিলে স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করেন তাঁর ‘দ্য গিফ্ট আউটরাইট’ কবিতাটি। কেনেডির অনুরোধে শেষ পঙ্ক্তিতে আমেরিকা সম্পর্কে বলা ‘সাচ অ্যাজ় শি ওয়াজ়, সাচ অ্যাজ় শি উড বিকাম’-এর বদলে কবিকণ্ঠে শোনা যায় আশার সুরের অনুরণন: ‘সাচ অ্যাজ় শি উইল বিকাম’।
ষাট বছর পেরিয়ে আজও ট্রাম্পবাদকে অগ্রাহ্য করে এটুকু আশা নিয়েই পথ চলে গণতন্ত্র। পৃথিবীর সর্বত্রই।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাত