ছবি: সংগৃহীত
সত্তরের দশকের দিকে কেউ যদি ফিরে তাকান, তাঁর মনে হতেই পারে যে, অগ্রবর্তী অর্থনীতির দেশগুলির বৃহৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র পরিচালনার সামনে এমন কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল, যা ইতিপূর্বে দৃশ্যমান হয়নি। বাণিজ্যচক্রের ওঠানামার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে দেখা দিয়েছিল মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্ব। বেকারত্বের হার এতখানি বেশি ছিল যে, তা অর্থনীতির গতিজাড্যকে কমিয়ে আনে বা বলা যায়, অর্থনীতিকে স্থবির করে ফেলে।
মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতাকে একত্রে প্রকাশ করেতে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ (স্ট্যাগনেশন এবং ইনফ্লেশন) নামে একটি অভিধাও এই সময় জন্ম নেয়। অর্ধশতক পরে এখনও যখন বিভিন্ন অর্থনীতির দেশের আর্থিক বৃদ্ধি কম হয় অথবা শূন্যে গিয়ে ঠেকে এবং অতিরিক্ত মাত্রায় মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হয়, সেই অভিধাটিকেই পুনর্বার ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সত্তরের দশকে অর্থনীতিবিদরা ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর মধ্যে জনগণ কী ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়, সে সম্পর্কে একটি ধারণা নির্মাণ করেছিলেন। এটিকে একটি ‘মিজারি ইনডেক্স’ বা ‘দুর্দশার সারণি’ বলা যেতে পারে, যেখানে ভোক্তাজগতের মুদ্রাস্ফীতি এবং বেকারত্বের হারকে একত্র করে দেখা হয়।
এখন যদি কেউ তেমন একটি ‘ইনডেক্স’ রচনা করেন, তা হলে কী দেখা যাবে? যদি দেখা যায় তুরস্ক, আর্জেন্তিনা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ, যেখানে অর্থনৈতিক অব্যবস্থা এবং অর্থনীতির ধারাবাহিক সমস্যা বিদ্যমান, সেখানে ‘দুর্দশা’-র হার সর্বোচ্চ, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই দেশগুলির পরেই যাদের কথা আসবে, তারা ‘ব্রিক্স’ অর্থনীতির (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা) দু'টি বৃহৎ দেশ— ব্রাজিল এবং যুদ্ধদীর্ণ রাশিয়া। এদের সঙ্গ দেবে পাকিস্তান এবং মিশর। তার পরেই আসবে ভারতের নাম। এবং এর পরে যদি দেখা যায়, ইউরোপের অগ্রগণ্য দেশগুলি এবং আমেরিকা এই বিষয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই, তা হলেও আশ্চর্য হবেন না।
‘মিজারি ইনডেক্স’-এর মধ্যে দু'টি পরিবর্তন আনা হয়েছে। একটি এই যে, অর্থনীতিগুলির উপরে চেপে বসা সুদের পরিমাণকে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে তুরস্ক, ব্রাজিল, রাশিয়া এবং পাকিস্তানের মতো দুর্দশাগ্রস্ত দেশগুলির ছবি আরও বেশি ভয়াবহ হিসেবে দেখা দেবে। কারণ, উচ্চহারের মুদ্রাস্ফীতির ফলে সুদের হারও চড়তে শুরু করে। কিন্তু একই সঙ্গে ভারত ও ধনী রাষ্ট্রগুলির মধ্যেকার দুর্দশার ব্যবধানও বাড়তে থাকবে, কারণ শেষোক্তরা মুদ্রাস্ফীতির হারকে ধারাবাহিক ভাবে কম রাখতে সমর্থ হয়েছে। ভারতের পক্ষে এমন অবস্থান, আর যা-ই হোক গৌরবজনক নয়। কেন না, বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিটি অঞ্চল থেকে ২০টি করে প্রতিনিধিমূলক দেশ নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করলে ভারত তার সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ২০টি দেশের মাঝামাঝি অবস্থানে বিরাজ করবে।
দ্বিতীয় যে পরিবর্তনটি আনা হয়, সেটি অর্থনৈতিক ক্লেশ লাঘবের পর মাথাপিছু আয় বৃ্দ্ধির হার। এ থেকে দেখা যায়, ভারত (২০২২ সালে বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে দ্রুততম বৃদ্ধির দেশ হিসেবে আশা করা হচ্ছে) তার নম্বর বাড়িয়েছে বটে, অবস্থান পরিবর্তনে সমর্থ হয়নি। যদিও এই পরিবর্তনটি তালিকার একেবারে নীচে থাকা অর্থনীতির দেশগুলির সঙ্গে অগ্রবর্তী অর্থনীতির দেশগুলির (যেহেতু এই দেশগুলির বৃদ্ধির হার কমই থাকে) ব্যবধানকে কমিয়ে এনেছে। এমনকি, জনসংখ্যাকে স্থবির অথবা ক্রমহ্রাসমান রাখার পরেও এমনই দেখা গিয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, সুদের হার এবং আয়ের বৃদ্ধি— এই চারটি বিষয় মাথায় রেখেও দেখা দেখা যায়, ভারত সেই ২০টি দেশের তালিকায় দ্বাদশ স্থানে বিরাজ করছে।
পরিবর্তিত ‘মিজারি ইনডেক্স’ বস্তুত মানুষ কেমন করে দিনাতিপাত করছে সে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, সেই সঙ্গে এই সারণি দুর্যোগের কালে অর্থনীতির স্থৈর্যের একটি সূচক হিসেবেও কাজ করে এবং এই মুহূর্তেও করে। ২০১৩-র দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, রাজকোষ এবং লেনদেন সংক্রান্ত তহবিলে ভারতের যুগপৎ ঘাটতি এ দেশকে ‘ভঙ্গুর পাঁচ’ (তুরস্ক, ব্রাজিল, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়া) অর্থনীতির অন্যতম করে রেখেছে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।