সফল: পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরে লেবার পার্টির সদর দফতরে দলনেতা জেরেমি করবিন। লন্ডন, ৯ জুন ২০১৭। ছবি: এএফপি
ব লা নেই কওয়া নেই প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে বিলেতে সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন। নিন্দুকের মতে, তিনি জানতেন, সেই সময় বিরোধী নেতা জেরেমি করবিন-এর ভাবমূর্তি তলানিতে এসে ঠেকেছে; নিজের দলেই তাঁকে কেউ পোঁছে না, দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তো দূর অস্ত্। অতএব, এই সময় ভোট হলে লেবার পার্টিকে দুরমুশ করে একচ্ছত্র আধিপত্য পাওয়ার ঈপ্সাতেই মে-র নির্বাচনের ডাক। অছিলা একটা ছিল বটে; জনসাধারণকে টেরেসা মে বলেছিলেন ব্রেক্সিটের পরে ইউরোপের সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য বিলেতের দরকার এক শক্ত প্রধানমন্ত্রী, অতএব তাঁকে বিপুল জনমত দিয়ে নির্বাচিত করা হোক। এ-ভাবেই বেজেছিল নির্বাচনের দামামা। ফল কী হল তা আমরা জানি। বহুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো দূর, কনজারভেটিভ দল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাই খোওয়াল; জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবারের আসন অনেক বাড়ল।
ফল বিশ্লেষণ করতে বসে অনেকেই ভাবছেন টেরেসা মে-র ফাটকাবাজি কাজে তো লাগলই না, বুমেরাং হয়ে গেল; কেউ বা বলছেন, গত বছরের ব্রেক্সিটের প্রতিশোধ নিলেন বিলেতের জনগণ; আবার কারও মতে, যুবসম্প্রদায় মে-কে মেনে নেননি। ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে প্রথমেই এটা মেনে নেওয়া যাক, নির্বাচনে মে হারেননি, জেরেমি জিতেছেন, সবাইকে চমকে দিয়েই। প্রশ্ন হল, কী ভাবে তিনি এই অসাধ্য সাধন করলেন?
ছোটবেলায় স্কুলের বিতর্কসভায় শিক্ষকরা আমাদের শেখাতেন প্রসঙ্গান্তরে না গিয়ে কী ভাবে সরাসরি বিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করে নিজের মত প্রকাশ করতে হয়; সমান্তরাল প্রসঙ্গে যতই যুক্তি খাড়া করি না কেন, তাতে আর যা-ই হোক, বিতর্কে জয় আসে না। বিলেতে নির্বাচনের আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে নেতাদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে সেই স্কুলের শিক্ষার কথা মনে পড়ছিল। এ তো শুধু বিতর্কসভা নয়, দেশের সাধারণ নির্বাচনের লড়াই; তবু, বিলেতের নেতারা, টেরেসা মে, জেরেমি করবিন, লিবারাল ডেমোক্র্যাট নেতা টিম ফ্যারন, স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির নিকোলা স্টার্জনরা, যেন নিজের নিজের ক্ষেত্র বেছে নিয়ে যুদ্ধ করলেন।
বিলেতের রীতি অনুযায়ী, নির্বাচনের আগে সব বড় দলগুলি তাদের ইস্তাহার বা ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করে। কনজারভেটিভ দলের প্রচারের মূল কথা ছিল ব্রেক্সিট— ইউরোপের বাইরে এসে বিলেত কী ভাবে এগোবে সেটাই একমাত্র চিন্তা; তাদের মতে, টেরেসা মে-র নেতৃত্বেই এটা সম্ভব, তাঁকে নির্বাচিত করলেই হবে; অন্যথা, লেবার নিজে বা ছোট দলগুলো নিয়ে এক জোটের নেতা হিসেবে জেরেমি করবিন সরকার গড়লে গাড্ডায় পড়তে হবে। কনজারভেটিভ ইস্তাহারে তাই অন্য সব বিষয় নামমাত্র, বলতে হবে তাই বলা।
অন্য দিকে, করবিন জানতেন, মে-র তুলনায় তাঁর জনপ্রিয়তা কম; দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি টক্কর দিতে গেলে তিনি হেরে যাবেন। তাই, তুলনায় সহজ উপায় হল, সমান্তরাল এক ক্ষেত্রে বিচরণ করা। তাঁর নেতৃত্বে লেবার তাই সরাসরি ব্রেক্সিট যুদ্ধে না গিয়ে ইস্তাহারের নাম দিল ‘ফর দ্য মেনি, নট দ্য ফিউ’— লেবার নিজের নীতি তৈরি করেছে সকলের কথা ভেবে, মুষ্টিমেয় কয়েক জনের উন্নয়ন তাঁদের উদ্দেশ্য নয়।
কী ছিল সেই ইস্তাহারে? এক কথায়, দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের সরাসরি উন্নয়নের জন্য একগুচ্ছ নীতি। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ফি লাগবে না, হাসপাতালগুলোতে পরিষেবা উন্নত হবে, ডাকব্যবস্থা, রেল ও পরিবহণ পুনরায় রাষ্ট্রায়ত্ত করে তাদের পরিষেবা সুলভ করে তোলা হবে, সামরিক বাজেট কমানো হবে, ইত্যাদি। জেরেমির এহেন পথ ও মত অতিরিক্ত বামঘেঁষা, আধুনিক ভোগবাদী বাজারি অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত তাঁর অপছন্দ, তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবস্থাতে বিশ্বাসী। তিনি চান, আগামী দিনের বিলেতের সাধারণ মানুষ যেন ভাল ভাবে থাকেন। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা ভেবে তিনি লেবারের নীতি স্থির করেছেন— উচ্চবিত্তদের করের হার বাড়িয়ে, সেই করের টাকায় তিনি সবার জন্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অর্থ বরাদ্দ করতে চান। এই সমাজবাদই হয়তো আখেরে দেশের উন্নতি করবে।
জেরেমি করবিনকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না এমন লোকের সংখ্যা লেবার সংসদীয় দলের মধ্যেই কম নয়, দলের বাইরের কথা তো দূরস্থান। কেউ কেউ তাই মনে করেছিলেন, দলকে ও দেশকে তিনি কয়েক দশক পিছনে নিয়ে যেতে চান, এ-ভাবে আর যা-ই হোক, দেশের সাধারণ নির্বাচন জেতা অসম্ভব। কিন্তু এটাই হয়তো ছিল জেরেমির শক্তি, আর এ-ভাবেই তিনি মে-কে চ্যালেঞ্জ জানালেন। এবং অনেক দূর অবধি সফল হলেন। আগামী লড়াই আরও হাড্ডাহাড্ডি হতে পারে, কয়েক সপ্তাহ আগেও বিলেতে বা ইউরোপে যা অভাবনীয় ছিল।
জেরেমি করবিনের ও লেবার দলের চিন্তাধারাকে রাজনীতির চিরাচরিত ডান ও বাম পন্থার ছক দিয়ে ধরতে গেলে হয়তো ভুল হবে। গরিবের কথা ভাবা-কে আমরা এক কথায় বামপন্থার তকমা লাগাই। আবার, ডান নীতি বলতে এখন আমরা বুঝি নিজের দেশের সাধারণ ভোটারের গণ্ডিতে থাকা; যেমন, ভারতে তথাকথিত ডান দলের স্লোগান হল আমাদের দেশটা হিন্দুদের, অতএব শুধু হিন্দুদের উন্নতির কথাই ভাবা দরকার, অথবা, বিলেতের ডান দল চায় পূর্ব-ইউরোপের লোকেরা দেশে ফিরে যাক, তা হলেই সাধারণ মানুষের উন্নতি হবে।
জেরেমি করবিন কিন্তু এক ঢিলেই এই দুই পাখি মারলেন; বাম নীতি নিয়েই ডান দল-ঘেঁষা ভোটারেরও মন জিতলেন, আর তাতেই তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়ে প্রায় মে-র কাছাকাছি। মে-র বিরুদ্ধে ব্রেক্সিট নিয়ে তর্ক না করে, শুধুমাত্র গরিবের সমস্যার কথা ভাবব— এ কথাটা জোর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেই তিনি বাজিমাত করলেন। বুঝলাম যে, স্কুলে শেখা বিতর্ক পদ্ধতি না মানলেও ক্ষতি নেই!
জেরেমির কাছে এই লড়াই করার শিক্ষা আমাদের রাজ্যের বাম দলগুলোও নিতে পারেন। আমাদের দলে এস, তা হলেই তোমার উন্নতি হবে— এই পাইয়ে-দেওয়ার রাজনীতি নয়, নতুন নীতি হতে হবে এমন, যাতে সকলের উন্নয়ন হয়।
ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক