ছবি: সংগৃহীত।
খাদ্য দফতরের ভান্ডারে চাল আসিবে কোথা হইতে, তাহার চিন্তা শুরু হইয়াছে। এ রাজ্যে এমন চিন্তা অভিনব। গণবণ্টন ব্যবস্থা, মিড-ডে মিল, অঙ্গনওয়াড়ি, সকল প্রকল্পের প্রয়োজন মিটাইয়াও খাদ্য দফতরের গুদামগুলিতে চাল উদ্বৃত্ত থাকিয়া যায়। এই বৎসর চিত্র বদলাইয়াছে। মহামারি ও লকডাউন-জনিত কর্মহীনতা সরকারি সহায়তার উপর নির্ভরতা বাড়াইয়াছে। রাজ্য সরকার ছয় মাস বিনামূল্যে চাল দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েই আরও অধিক মানুষকে আরও অধিক পরিমাণে চাল দিবার সঙ্কল্প করিয়াছে। এ রাজ্যে বর্তমানে বিবিধ খাদ্য সহায়তা প্রকল্পে যত চাল বিতরণ করা হইতেছে, তাহা স্বাভাবিক সময়ের দ্বিগুণ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিয়াছে, দ্রুত চাল সংগ্রহের নীতি কী হইবে? এখনও অবধি চালের ঘাটতি নাই। বোরো ধানও উঠিবার সময় হইয়াছে। রাজ্যে দুই কোটি টনের অধিক ধান উৎপন্ন হয়, তাহার ত্রিশ শতাংশ বোরো ধান। ফলে, ধান আছে। প্রশ্নটি খরিদ নীতির। সরকারি ক্রয় কেবল উপভোক্তার স্বার্থে নহে, চাষির স্বার্থেও বটে। বস্তুত, গত কয়েক বৎসরে চাষির ন্যায্য মূল্য পাইবার প্রশ্নটি রাজনীতির কেন্দ্রে আসিয়া পড়ায় সরকারি ক্রয়ের ব্যবস্থাপনায় গণবণ্টনে চাল বিতরণের লক্ষ্য যেন তুলনায় পিছনের সারিতে। মুখ্য হইয়াছে চাষির নিকট ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পৌঁছাইবার লক্ষ্য। গত বৎসর রাজ্যে ১২ লক্ষেরও অধিক চাষি সরকারের নিকট নাম নথিভুক্ত করিয়াছিলেন। তাঁহাদের হইতে সরকার ৩৪ লক্ষ টন ধান খরিদ করিয়াছে সহায়ক মূল্যে। শিবির করিয়া ধান ক্রয়, পরিবহণ, অতঃপর চালকলগুলি হইতে ধান সংগ্রহ, চাষির নিকট ক্রয়মূল্য পৌঁছানো— এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সময়, পরিশ্রম ও খরচসাপেক্ষ।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসিবার পর সেই প্রক্রিয়াটি লইয়া বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হইয়াছে। সরকারি গুদামের সংখ্যা বাড়িয়াছে, সরকারের দ্বারা সংগৃহীত ধানের পরিমাণও। এখন অতিমারি-জনিত আপৎকালীন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠিতেছে, সরকার কি এই দীর্ঘ ও জটিল পদ্ধতি মানিয়াই ধান সংগ্রহ করিবে? প্রশ্ন শুধু সময়ের নহে, খরচেরও। চাষিকে ধানের ন্যায্য মূল্য দিবার ফলে সরকার যে দামে চাল কেনে, তাহা বাজার মূল্য হইতে চড়া। রাজকোষে অর্থ লইয়া টানাটানি, ফলে বাজার হইতে স্বল্প মূল্যে চাল কিনিবার ইচ্ছা স্বাভাবিক। কিন্তু চাষির স্বার্থ দেখিবার প্রয়োজনও কি এখনই সর্বাধিক নহে? লকডাউনের ফলে পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যাহত হইয়াছে, ফল-ফুল-আনাজ বিপণনে বিপুল ক্ষতি হইয়াছে চাষির। বাংলার চাষির প্রধান উৎপাদন ধান। সরকারি মূল্য ধানের বাজারকে প্রভাবিত করে বলিয়া সকল চাষিই সরকারি ক্রয়ের কিছু সুবিধা পায়। এই দুর্দিনে আরও অধিক সরকারি ক্রয় চাষিকে আশ্বস্ত করিবে, সন্দেহ নাই।
সংবাদে প্রকাশ, এফসিআইয়ের গুদাম, কিংবা খোলা বাজার হইতে চাল সংগ্রহের তুলনায় চাষির নিকট অধিক ধান কিনিতে উৎসাহী খাদ্য দফতরও। সংশয়, অধিক ক্রয়ের সুযোগ লইয়া দুর্নীতি বাড়িবে না তো? গণবণ্টনে প্রাপ্ত স্বল্প মূল্যের বা বিনা মূল্যের চাল বিক্রয় করিয়া দেন অনেক গ্রাহক, তাহাই ফের অসাধু ব্যবসায়ীর দ্বারা ‘ন্যায্য মূল্যে’ সরকারের নিকট ফিরিয়া আসে। ভুয়া খরিদের আরও নানা দৃষ্টান্ত ধরা পড়িয়াছে বারবার, অনেক চালকল মালিকের নাম কাটিয়াছে সরকার। রাজনৈতিক স্বজনপোষণের অভিযোগও উঠিয়াছে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে নিয়মিত নজরদারি শিথিল হইবার সুযোগে দুর্নীতি বাড়িবার ঝোঁক থাকে, কাজেই বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। এখনও ধানের অভাব নাই, কিন্তু সরকারি ক্রয়ে ভ্রান্ত নীতি এবং দুর্নীতি চাষির বিপন্নতা বাড়াইলে কৃষির বাজার বিপর্যস্ত হইবে। তাহাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপদ বাড়িবে।