বরফ গলছে মেরুতে। ছবি: আইস্টক
আটত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস—সাধারণত গ্রীষ্মকালে এমন তাপমাত্রার সঙ্গেই আমরা অভ্যস্ত। গত কয়েক বছরে এই তাপমাত্রা বা তার থেকে বেশি তাপমাত্রা লক্ষ করা গিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নানা দেশ ও আমেরিকার নানা প্রদেশে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে ধারাবাহিক তাপপ্রবাহের সাক্ষী থেকেছে ইউরোপের বিস্তীর্ণ অংশ ও আমেরিকা। তার জেরে বেড়েছে দাবানলের মতো ঘটনাও।
কার্য-কারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে বসে আবহাওয়া পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নকে দায়ি করেছিলেন গবেষকেরা। তবে এ বার এই তাপমাত্রা দেখা দিল মেরু লাগোয়া সাইবেরিয়াতেও। তার জেরে সাম্প্রতিক সময়ের রেকর্ড গরমের সাক্ষী থাকতে হল এই এলাকাকে। উচ্চ তাপমাত্রার জেরে বেড়েছে দাবানলের ঘটনাও। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, জুন মাসে সাইবেরিয়া ও তার সন্নিহিত মেরু লাগোয়া এলাকার গড় তাপমাত্রা ছিল কমপক্ষে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা স্বাভাবিকের তুলনায় অন্তত আঠারো (১৮) ডিগ্রি বেশি। এর জেরে তুন্দ্রা অঞ্চলীয় অরণ্যেও দাবানল বিধ্বংসী আকার ধারণ করেছে বলে জানান গবেষকেরা। তাঁদের দাবি, ১,৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বন দহনের ফলে, অন্তত ৫৯ টন বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয়েছে যা আগামী দিনে এই এলাকার বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পরিবেশ গবেষকদের দাবি, তীব্র ও শুকনো গরম সাইবেরীয় অঞ্চলে নতুন নয়। এর আগেও এমনটা ঘটেছিল। পঁচিশ ডিগ্রিরও বেশি তাপমাত্রা ওঠা, দাবানল, প্রভৃতি ঘটনা এর আগেও সাইবেরিয়াতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু এ বারের ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই দাবি করছেন গবেষকেরা। তাঁদের দাবি, এমনিতে গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিক ভাবে লকডাউন ও গণপরিবহণ বন্ধ থাকার কারণে ইউরোপের নানা দেশে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা অনেকটাই কমেছে। নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ভারত-সহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণও। এই সময়ের মধ্যে সামুদ্রিক দূষণ কমার জেরে দেখা মিলতে শুরু করেছে সামুদ্রিক প্রাণীদের। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, এরই সঙ্গে সূর্যের শীতল দশা চলার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ বারে আর্দ্র আবহাওয়া ও প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সুমেরু অঞ্চলের ধারাবাহিক পরিবর্তন চিন্তিত করে তুলেছে বিজ্ঞানীদের। তাঁদের দাবি, মাসখানেক আগে সুমেরু অঞ্চলে ওজন স্তরে এক বিরাট মাপের ছিদ্রের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এ বার দেখা দিল তীব্র গরম ও দাবানল। পুরো বিষয়টি এক গভীরতর উদ্বেগের পরিচয় দিচ্ছে বলেই মনে করছেন গবেষকেরা।
তাঁদের দাবি, এখনও পর্যন্ত সুমেরু লাগোয়া সাইবেরিয়ার এই অংশগুলিতে সর্বাধিক পঁচিশ ডিগ্রি পর্যন্ত পারদ উঠতে দেখা গিয়েছিল। এ বারে তা এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। এর আগে কখনও এক ধাক্কায় গত বছরের থেকে পারদ এতটা উর্ধ্বমুখী হতে দেখা যায়নি বলেই জানান গবেষকেরা। তাঁদের দাবি, গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই এলাকায় বাড়ছে শীতের তীব্রতাও। ২০১৮ সালে তীব্র ঠান্ডা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে এই এলাকায় প্রাণীদের প্রজননের হার শূন্যে নেমেছিল। অদূর ভবিষ্যতেও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই ধরনের বিপর্যয় এখানকার প্রাণীদের স্বাভাবিক জীবচনক্রে ভয়াবহ বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে বলেই দাবি করছেন গবেষকেরা। তাঁদের দাবি, বরফ গলার ফলে, জলতলের উচ্চতা-বৃদ্ধি, বরফের ভিতরে আটকে থাকা নানা রোগ জীবাণুর মুক্তির মতো ঘটনা তো রয়েছেই, তারই সঙ্গে এই এলাকা যদি প্রাণীশূন্য হয়ে যায় তা হলে কিন্তু চরম খেসারত দিতে হবে মানুষদের। আবার ওজোন স্তরের ক্ষয় নানা মহাজাগতিক রশ্মির হাত থেকে এই এলাকাকে রক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের। তাই এই সমস্যা মেটাতে সুমেরু অঞ্চল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার বাস্তুতন্ত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্তুরে আলাদা করে গবেষণার পরিকাঠামো তৈরির দাবিও তুলছেন বিশেষজ্ঞেরা।