ছবি: সংগৃহীত
ওরা স্কুলে আসে প্রতি বছর। মুখগুলো। কুঁড়িগুলো। সরকারি প্রকল্পের সাদা-সবুজ স্কুলপোশাকে, সবুজ সোয়েটারে, হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে কুয়াশা জড়িয়ে। হাতের মুঠোয় ভরে আনে চন্দমল্লিকা, গাঁদা, ডালিয়া— আরও কত-কত নানা মরসুমি ফুল আর পাতা। সারা শহর যখন ঘুমোচ্ছে মাঘের শীতের জবুথবু সকালের লেপ-কম্বলের ওমে, তখন গেরুয়া-সাদা-সবুজ রঞ্জিত ত্রিবর্ণ পতাকার সামনে উত্তেজনা-মাখা এক ঝাঁক নবীন এসে ভিড় করেছে।
না, আজ ওদের মিড-ডে মিল নেই মোটেই। গোটা বা আধখানা ডিমের জন্য আসেনি আজ ওরা। স্কুলে যে লাড্ডু, লজেন্স বা বিস্কুট দেওয়া হবে, তার জন্যও না। ওরা শুধু জানে, আজ একটা বিশেষ দিন। ছুটি, কিন্তু ছুটি নয়। স্কুলে দিনটা পালন করা হয়। আর জানে, আজ জাতীয় পতাকাকে অভিবাদনের দিন। আজ প্রজাতন্ত্র দিবস। আবেগতাড়িত বাচ্চাগুলোর ধর্ম-বর্ণ-জাতি-শ্রেণি যেমন এই স্কুলপোশাকের কাছে তুচ্ছ ও অপ্রয়োজনীয়, ঠিক তেমনই ‘ভারতবাসী’ পরিচয়ের কাছেও তুচ্ছ মনে হয় যাবতীয় অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়।
এই আবেগটার নামই স্বাধীনতা, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র।
এখানে প্রজার বিপরীতে কোনও ‘রাজা’ নেই। আছে শুধু এক জাতীয় চেতনা। বাচ্চাগুলো জানে না যে, কে এ দেশের প্রজা আর কে নয়, তা নিয়ে তরজায় এই মুহূর্তে উত্তাল আসমুদ্রহিমাচল। ওরা ইতিহাস বইয়ে পড়েছে, অনেক লড়াইয়ের পর স্বাধীনতা এসেছিল এই দেশে। ওরা দেখেছে, ইতিহাস পড়াতে গিয়ে স্কুলে শিক্ষকেরা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন আজও। তাঁরা বলেন ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক সার্বভৌম এক ধারণারা কথা।
শুধু স্বাধীন হলেই তো সবটুকু পাওয়া হয় না, স্বাধীনতা উপভোগ আর উদ্যাপনের আবশ্যিক শর্ত হল নিজের মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ে একই সঙ্গে সচেতন এবং উদ্যোগী হওয়া। পতাকাকে অভিবাদন করা আর জাতীয় সঙ্গীতের উচ্চারণ আমাদের যে মানসিক তৃপ্তি দেয়, জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের মর্যাদার প্রতি উন্মুখ করে, ছাত্রছাত্রীদের সেই স্পর্শটুকুই দিতে চাই আমরা। যখন প্রশ্ন তোলে কোনও কৌতুহলী মুখ— প্রজাতন্ত্র মানে ঠিক কী? তখন বোঝাতে হয়— এ আসলে সাধারণতন্ত্র। সাধারণের জন্য সাধারণের তৈরি শাসনব্যবস্থা। ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। সংবিধান নাগরিকদের সেই অধিকার দিয়েছে। তাঁরা দাবি করতে পারেন রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের জন্য সমান ব্যবহার ও পক্ষপাতহীন নিরাপত্তা এবং মৌলিক প্রয়োজনগুলির। শাসকনিরপেক্ষ ভাবেই পারেন। কারণ, এই প্রজাদের ক্ষমতাতেই শাসকের ক্ষমতা নির্মিত হয়। নাগরিকেরও তেমন অধিকারের সীমা বুঝে নেওয়ার মতোই আছে কর্তব্য-দায়িত্ব। ক্ষমতা আর দায়িত্ব হাত ধরাধরি করে চলে বলেই অধিকারের সীমা জেনে নেওয়া জরুরি। নিরঙ্কুশ-নিঃসংশয় প্রশ্ন করার স্বাধীনতা চেয়েই তো একদিন পথে নেমেছিলেন পরাধীন ভারতের মানুষ। সংবিধান সেই পবিত্রতম গ্রন্থ, যা আমাদের নিজস্ব মত প্রকাশের আর অন্যের মতের প্রতি সহিষ্ণুতার কথা একই সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছে।
২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ ভারতের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার অঙ্গীকারের কথা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উল্লেখ করে থাকলেও সাত দশক পার করেও সবই কী রকম ভোরের কুয়াশার মতোই আবছা আর অনিশ্চিত হয়ে রয়ে গেল আমার দেশে! দেশের উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদেশনীতি, প্রজাতন্ত্র দিবসের হরেকরকম লোভনীয় ছাড়ের জাঁকজমকের আড়ালে সেই একই জং-ধরা গড়িয়ে-গড়িয়ে চলা নিরাপত্তাহীনতা! অপুষ্ট, অশিক্ষিত, নির্যাতনের শিকার দরিদ্র দেশবাসীর সেই অন্তহীন লড়াই! কর্মসংস্থানের বিবিধ সরণি উন্মুক্ত হলেও স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়েই পড়ে থাকলেন দেশের অজস্র মানুষ— কর্মহীন, খাদ্যবস্ত্রহীন, নিরাপত্তাহীন! নারী নিরাপত্তা, দুর্নীতি রোধ ইত্যাদি প্রশ্নে লড়াই ফুরোল না সাধারণ মানুষের! শুধু শাসকের রং বদলায়, নীতি বদলায়, কিন্তু দিন বদলায় না!
জাতীয় দিবস পালনের গুরুত্ব জানতে পারিনি দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষকে প্রশ্ন করে। তাঁদের বরং অাতঙ্কিত প্রশ্ন— ‘কতবার ভিটে হারাব আর? আবার কি দেশ ভাগ হয়ে যেতে পারে? কোথায় যাব?’ ভারত মানে যদি অখণ্ড এক চেতনায় বাঁধা কোটি কোটি নাগরিকের একাত্মতাই হয়, তবে খুব জরুরি জাতীয় দিবসের ঠিকঠাক পর্যালোচনা, খুব জরুরি এর গুরুত্ব সাধারণ মানুষকে বোঝানো। যে সহিষ্ণুতার কথা সংবিধান ঘোষণা করেছে, তা থেকে যেন কোনও মূল্যেই আমরা বিচ্যুত না হই! ঠিক কতটুকু সহিষ্ণুতা আর কতটুকু স্বাধীনতার সীমা টপকে গেলে আচরণ উগ্রতায় রূপান্তরিত হতে পারে, এই সূক্ষ্ম ভেদাভেদটুকু জানাও খুবই জরুরি। না হলে সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যার অবকাশ থেকে যায় যে কোনও ভুল পাঠের মতোই! যাঁদের যাবতীয় প্রাপ্তি, প্রত্যাশা, হতাশা এই ভূখণ্ড ঘিরেই, সুযোগ পেলেই যাঁরা অন্য দেশে চলে গিয়ে উপার্জন করা বা জীবন কাটানোর কথা ভাবেন না, ইচ্ছে, লোভ বা সময়বিশেষে ক্ষমতা কোনওটাই নেই যাঁদের, তাঁদের বোঝানো দরকার যে, সংবিধানের প্রতিটি শব্দ তাঁদের জীবনমন্ত্র হতে পারে।
দেশকে দশের করে তোলার ব্রত ওই কাঁচা মুখগুলোই একদিন নিতে পারে, নেবেও। যারা অন্যদিকে বসে সামান্য হলেও অর্জন করেছি অথবা সুযোগ পেয়েছি প্রজাতন্ত্র দিবসের অর্থ উপলদ্ধির, তারা যেন শুধু নেতিবাচক দৃষ্টিতে না দেখি এই দিনটিকে বা শুধু ক্যালেন্ডারের একটি পালনীয় ছুটি বলে রঙ্গে না মেতে উঠি। এর প্রবাহ বজায় থাকুক সারা বছরের সচেতনতায়। দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, সম্প্রীতি যদি নতুন করে প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়, তা হলে যেন তা নিয়ে রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা ও সংশয় প্রকাশের অবকাশ থাকে। রাষ্ট্রেরও বাধ্যবাধকতা আছে প্রতিটি নাগরিকের প্রতি। গণতন্ত্রে শাসক কখনওই রাজা নন, আর তাই প্রশ্নাতীতও নন।
প্রতিটি নাগরিকের সংশয়ের সব বিন্দু নিরসন করা আদর্শ হলেও হয়তো সব সময় সম্ভব নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল ভাবনা তো এটাই যে, সংখ্যাগুরুর সুর-স্বরের আড়ালে যেন সংখ্যালঘুর সুর-স্বর ঢেকে না যায়। তা না হলে যে সঙ্গীতের, জাতীয় সঙ্গীতের প্রাথমিক শর্তটিই বিঘ্নিত হয়! এ শর্ত বজায় রাখার ঐতিহ্য ভারতের চিরকালীন আর তাকে মান্যতা দিতেই প্রজাতন্ত্রের উদ্যাপন।
সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমাদেরই পূর্বপ্রজন্ম স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিয়ে, চূড়ান্ত নির্যাতন সহ্য করে, প্রাণের মূল্যে এই স্বাধীনতা এনেছেন। তাই এই স্বাধীনতা, এই সাধারণতন্ত্র আমাদের প্রত্যেকের। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মূল সুর ছুঁয়ে থাকুক আমাদের। আরও বেঁধে বেঁধে থাকা, আরও নম্রতা, আরও সহমর্মিতা আশা করে, দাবি করে জাতীয় পতাকা। সহিষ্ণুতার অভিজ্ঞান সেই পতাকার সামনেই দাঁড়িয়ে আমরা, আমাদের বাচ্চাগুলো।
(লেখক ময়নাগুড়ির খাগড়াবাড়ি উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)