এখন সতর্ক থাকার সময়
West Bengal

নানা রঙের মানুষ নিয়েই বাংলা ও বাঙালি, ভুলে যাব কি সেটা

কয়েক দিন ধরে ভাবছি ওই পাহারাওয়ালার (শিবরাম চক্রবর্তী, বাড়ি থেকে পালিয়ে) কথা, যে হিন্দিতে আচ্ছা গানা থাকা সত্ত্বেও বাংলা গানাই ভালবাসে।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২১ ০১:১৮
Share:

বাড়ি থেকে পালিয়ে কাঞ্চন কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দিশেহারা, একে সে কিছু চেনে না, তায় সে বড্ড ছেলেমানুষ। পথে একটা পার্ক দেখে বসে পড়ল ঢুকে। ‘‘খানিক বাদে একটা কনস্টেবল এসে তার পাশে বসল। একটু পরে সে গান ছেড়ে দিলে ‘নৌতুন গাসে নৌতুন নৌতুন ফুল ফুটিয়েসে, আরে নৌতুন গাসে—’ পাহারাওয়ালা গান গায়! এই অদ্ভুত দৃশ্যে কাঞ্চনের অত্যন্ত হাসি পেল। হাসি চেপে সে গম্ভীর ভাবে বললে, ‘বাঃ পাহারাওয়ালা সাহেব তুমি তো বেশ বাংলা গান গাইছ!’ পাহারাওয়ালা গর্বের সহিত বললে— ‘হামি আঠ বরেষ বাংলা মুলুকে আসে— বহুৎ বাংলা শিখিয়েসে। হামার হিন্দীমে ভি আচ্ছা গানা আছেন, কিন্তু বাংলা গানাই হামি ভালবাসে।— আরে নৌতুন গাসে নৌতুন নৌতুন...’।’’

Advertisement

কয়েক দিন ধরে ভাবছি ওই পাহারাওয়ালার (শিবরাম চক্রবর্তী, বাড়ি থেকে পালিয়ে) কথা, যে হিন্দিতে আচ্ছা গানা থাকা সত্ত্বেও বাংলা গানাই ভালবাসে। ভাবছি ‘মিউটিনিমে তলোয়ার-খিলানো’ ফেকু পাঁড়ের কথাও (পরশুরাম, বিরিঞ্চিবাবা)। আর আমার চির-প্রিয় চরিত্র তো ঝগড়ু, যে বোগি-রুমুকে তার দুমকার গ্রামের বাড়ির প্রসঙ্গে বলেছিল, ‘‘লোকে তো স্বপ্ন দেখে বোগিদাদা, আর তাই কোনো দুঃখু তার গায়ে লাগে না। নেশা করবারও দরকার হয় না।’’ (লীলা মজুমদার, হলদে পাখির পালক)। ‘সাব-অলটার্ন’ চরিত্র বলে এরা মোটেই আমাদের কম প্রিয় নয়, খড়্গ বাহাদুর (শজারুর কাঁটা, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়) বা ভায়োলেট স্টোনহ্যামের (থার্টি-সিক্স চৌরঙ্গী লেন, অপর্ণা সেন) মতোই এরা আমাদের মনের ভিতরের বাসিন্দা। কত অবাঙালি চরিত্র, সেই সংখ্যা গোনাটা ছেলেমানুষি। আবার, পাহারাওয়ালাকে হাসি চেপে মন্তব্য করার মধ্যে যে রসিকতা আর ব্যঙ্গ, সেটাকে বিদ্বেষ বলে ভুল করাটাও চূড়ান্ত বোকামি। আমাদের চার পাশটা এই রকম ছোটবড় রংবেরঙের মানুষ দিয়েই তৈরি, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিও।

এই যে নানা রং, প্রতি দিনের পথের পাশে তা ছড়িয়ে থেকেছে। পঞ্জাবি প্রতিবেশীরা ডেকে ডেকে নানপুরি খাওয়াতেন। বন্ধুর বাড়ির উপরে বিহারের আন্টিরাও খাওয়াতেন, কপালে মেটে রঙের সিঁদুর। নিউ মার্কেটের গুজরাতি-হিমাচলি ব্যবসায়ী ‘দাদা’রা, আমার পছন্দের জিনিসটা আলাদা করে রেখে দিতেন বলে কলেজ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যেতাম। অনার্স-ক্লাসের পরম বন্ধু কেরলের মেয়েটি দুঃখ করত, বিয়ে হলে যদি কলকাতা ছেড়ে দিতে হয়! তা-ই হল, চলে গেল পার্বতী রাধাকৃষ্ণন, ভাঙা বাংলায় মিষ্টি কথা কানে বেজে রইল, যত দিন না হোয়াটসঅ্যাপ আবার ফিরিয়ে দিল তাকে। ভাই যখন উত্তরপ্রদেশীয় বান্ধবীকে বিয়ে করল, কী আনন্দ দুই পরিবারে, নতুন বৌ আর তার অল্পবয়সি মা, দুই জনেই যেন আমার মায়ের মেয়ে হয়ে গেল। কন্যার প্রাণের বন্ধু, মারোয়াড়ি বন্ধু, সে তো বাড়িরই মেয়ে। শুনি তার কাছে, ছোটবেলায় তার নাচের ফাংশান মানেই ‘মম চিত্তে’, ‘ধানের খেতে’ প্লাস ‘ওম শান্তি ওম’। বিদেশে বসে দিল্লি কাশ্মীর চেন্নাইয়ের বন্ধুরা বলে, কলকাতা কী দারুণ শহর, দিল্লির মতো চকচকে না হলেও ভিতরে খুব ‘কসমোপলিটান’, ‘লিবারাল’। মরাঠি গবেষক মেয়েটি চলেই এল কলকাতায় স্থায়ী শিক্ষক হয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারমশাইদের মধ্যে কে বাঙালি কে অবাঙালি ভাবিওনি, অধ্যাপক বাসুদেবন আমাদের ভারী পছন্দের মানুষ, এত স্নেহ দিতেন সকলকে, চোখের সামনে খুলে দিতেন ইউরোপীয় ইতিহাসের আকাশটা। বাবা-মায়ের বন্ধুরা অনেকেই বিবাহ করেছেন বিদেশিকে, কিংবা অন্য প্রদেশীয়কে। আমাদের সঙ্গীতগুরুরা কত জনেই বাঙালি নন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তো ননই, রবীন্দ্রসঙ্গীতেও নন। রাজেশ্বরী দত্ত, মোহন সিংহ খাঙ্গুরা, মনোজ মুরলী নায়ার, এঁদের পরিচয় কি আলাদা করে বলার?

Advertisement

এভাবেই তো পেলাম বাংলা ও বাঙালির মুক্তিকে। কলকাতার মাটিতেই দুনিয়াকে জানলাম, ভালবাসলাম। বাইরে গিয়েও ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়েছিল এই কলকাতাতে, যেটা ছিল, এখনও আছে।

আর ওই কলকাতা, যেটা এখন তৈরির চেষ্টা হচ্ছে? ভয় লাগছে সেটাকে দেখে। খুব ভয়। চোখের সামনে শহরটাকে এমন ভাগাভাগি করার বন্দোবস্ত দেখিনি আগে। অবাঙালি-বাঙালি সব মিলেমিশে একাকার আমাদের চার পাশে, এমন কখনওই নয়। কিন্তু ‘একাকার’ হওয়ার দরকার কী, সবাই মিলে পাশাপাশি শান্তিতে বাস করাই তো আসল। এই শান্তিটা এখন উবে যেতে বসেেছ, তাই এত কথা আবার নতুন করে বলতে বসা।

শুনছি, বাঙালি নাকি কোনও দিন অবাঙালিদের পাত্তাই দেয়নি, তাই আজ অবাঙালিদের ‘দিন আসছে’। কারা বলছেন এ কথা? বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতি মনমেজাজ, কিছুর সঙ্গেই তাঁরা কি পরিচিত? আজ রাজনীতির কারণে তাঁদের এই অসত্য কথা কত মানুষ শুনে বিশ্বাস করছেন! যাঁরা শামুকের খোলসে থাকাটাই আদর্শ বলে মনে করেন, মনে করেন একটা ভাষা একটা ধর্ম একটা পরিচয় ছাড়া আর সব বাতিলযোগ্য এবং বাতিল-কর্তব্য— তাঁদের কাছে আজ বাঙালি পাঠ নেবে সমাজ-সংস্কৃতির?

ইচ্ছে করেই জট পাকানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। রাজ্যের বাইরে এক দেশ এক ভাষা এমনকি এক ভোট বলে চেঁচিয়ে এসে আজ রাজ্যের ভিতরে বিপাকে পড়ে বহুত্ব আওড়াচ্ছেন, বাংলায় অবাঙালির প্রতাপ মনে করাচ্ছেন। বলছেন, কলকাতাই মিনি ভারতবর্ষ। এ দিকে তাঁদের নিজেদের মনেই জটটা যে হেতু বড্ড বিশাল, গুলিয়ে যাচ্ছে সব। ভারতবর্ষ বলতে তাঁরা বোঝেন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান, তাই মিনি ভারতবর্ষে এসেও তাঁদের কাছে ‘ভাইপো’-রাজনীতি হয়ে যাচ্ছে ‘ভাতিজা’-রাজনীতি, বাঙালি নেতা নতুন দলে ঢুকেই বাংলা বদলে হিন্দিবাচনের সৌরভে মত্ত। ‘বহুত্ব’ বলতে তাঁরা বোঝেন ‘একত্ব’কে বহু মানুষের মেনে নেওয়া— তাই, অবাঙালির গুণ বোঝাতে গিয়ে আবার অমর্ত্য সেনকে গালি দিতে হচ্ছে তাঁর একাধিক সংস্কৃতিতে বিবাহের কারণে। এমন বিবাহ যে মিনি ভারত-এর বাঙালির কাছে লজ্জা নয়, বরং গর্বের বিষয়— সেটা তাঁরা বুঝবেন কী করে?

তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, কলকাতা বিলক্ষণ জানে যে সে মিনি ভারত। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই, স্বাধীনতার পরও, এত দশক ধরে। অন্য ভারতীয় মহাশহরগুলোর তুলনায় এই দিকে অনেক দিন সে রীতিমতো এগিয়ে ছিল, উন্নয়নে পিছিয়েও কসমোপলিটানিজ়ম হারায়নি, বাঙালি সংস্কৃতির প্রখর সূর্যালোকেও সঙ্কীর্ণতা আঁকড়াতে চায়নি। প্রাক্তন আইসিএস অশোক মিত্রের একটা লেখায় পড়ি, কত রকম হিসেব কষে দেশের সব শহরের মধ্যে বেছে বেছে কলকাতাকে প্রথম মেট্রোর শিরোপা দেওয়া হয়েছিল। কলকাতা থেকে মানি-অর্ডারের সংখ্যাই বলে দেয় দেশের অন্য জায়গার কত মানুষ এখানে থাকেন, কাজ করেন, ঘরে টাকা পাঠান। কলকাতার গঙ্গার ধারে হাঁটলেই দেখা যায় বাংলার সঙ্গে জড়ো হয়েছে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, উত্তর-পূর্ব, দাক্ষিণাত্য। সাম্প্রতিক সংবাদপত্র আজও রিপোর্ট করে, বড়বাজারের উত্তর-ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা কলকাতায় থাকেন, কাজ করেন, কেননা এখানে ‘‘সকলে শান্তিতে থাকে, কোনও ঝুটঝামেলা নেই।’’ ‘‘হিন্দু-মুসলিম, বেঙ্গলি-ননবেঙ্গলি, এভরিওয়ান।’’ ‘‘এমনটাই যেন থাকে।’’

এখন, হিন্দু-মুসলিম ভাগাভাগিটাই যাঁদের অ্যাজেন্ডা, তাঁরা হঠাৎ বেঙ্গলি-ননবেঙ্গলি নিয়ে পড়লেন কেন, এটা গুরুতর প্রশ্ন। সম্ভবত কারণটা লুকিয়ে বাংলা ও বাঙালির মধ্যেই। মুসলমান-বিদ্বেষে বাঙালি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটা বোঝা যাবে সামনের ভোটে, তবে সন্দেহ করা যেতে পারে, বিদ্বেষ-স্কেলে যতটা উঁচু স্কোর ‘আশা’ করা হয়েছিল, তার কিছু কমতি পোষাতেই বেঙ্গলি-ননবেঙ্গলি তাসটা তাক থেকে ঝেড়েঝুড়ে নামানো হল। এমন ভাবেই নামানো হল যে অন্য দিকের রাজনীতিকেও আজ তাসটা হাতে তুলে নিতে হচ্ছে।

অথচ একটু সতর্ক থাকলে এই সব বিদ্বেষ-চাল ব্যর্থ করে দেওয়া যায়। এত দশকের এত ভোটের পর ২০২১-এর ভোটের আগে প্রথম শুনতে হচ্ছে বাঙালি-অবাঙালি হিন্দু-মুসলমান ‘বিদ্বেষ’ কথা— এর মধ্যে যে আকাশপ্রমাণ লজ্জা, সতর্ক থাকলে সেটার পাশ কাটানো যায়। যে রাজনীতি আইডেন্টিটির লড়াই বাধিয়ে আর সব গুলিয়ে দেয়, ঘৃণার বিষ ছড়ায়, তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, বাঙালিকে তার কিছু দেওয়ার নেই, কেবল এত দিনের প্রাপ্তি, অর্জন সব ফিরিয়ে নেওয়ার ফন্দি আছে। এগোনোর কথা নেই, কেবল পিছোনোর কথা আছে। ভালবাসার কথা নেই, শুধু ঘৃণার কথা আছে।

২০২১ এল। সতর্কতার সঙ্কেত নিয়ে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement