নিজের ভাষায় নিজেরই কুড়ুল

নব্বই দশক থেকে বাংলা মিডিয়াম বনাম ইংরেজি মিডিয়ামের ফারাকটা এক রকম অসেতুসম্ভব ফারাক তৈরি করল। আশির দশকেও মনে পড়ে, ‘বাংলা মিডিয়াম আমি’ ক্লাস ইলেভন-এ ইংরেজি মাধ্যম বান্ধবীদের সঙ্গে সামান্য ঠোকাঠুকির পর সাম্যে স্থিত হয়েছিলাম, হীনম্মন্যতা কেটে গিয়েছিল।

Advertisement

যশোধরা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share:

আবার এগিয়ে গেল দক্ষিণ ভারত। সমস্ত অ-হিন্দিভাষী রাজ্যে হিন্দি বাধ্যতামূলক করার কথা উঠতে যে ঝড় উঠেছিল, তাতে তামিলনাড়ু-সহ দক্ষিণের রাজ্যগুলোর প্রবল প্রতিবাদ চোখে পড়ল সকলের। আর বাংলাভাষীদের দিক থেকে যে রব উঠল, তাকে সামান্য আলোড়ন মাত্র বলা যায়। অনেকে হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা জীবনানন্দ অনুবাদ করে দেখালেন তা কত হাস্যকর। হাসিঠাট্টার ছলেই বাঙালি হেরে গেল আবারও। এই সেই বাঙালিরা, যারা পারিনি বাংলাকে বাংলার কেন্দ্রীয় বোর্ডের স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলক করতে, বা অনেক রাজ্যের মতো নিজেদের ভাষা নিয়ে অহঙ্কার করতে।

Advertisement

অথচ আজই কিন্তু আমরা অন্য ভাষার আগ্রাসন প্রথম দেখছি না। ভারতের বাঙালিরা নিজেদের ভাষা নিয়ে কোনও লড়াই-ই লড়ে উঠতে পারিনি কত দিন। ও পার বাংলার ২১ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে শিলচরের ১৯ মে-ই কি এ পারে আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রথম ও শেষ জয় হয়ে রইল?

আর, হয় তুমি অন্য ভাষাকে চোখ বুজে গ্রহণ করবে, নয় বাংলাকে, এমন দ্বৈততাই বা কবে এল? একদা কিন্তু ভাল বাংলা জানার সঙ্গে অন্য ভাষা জানার কোনও বিরোধ ছিল না। প্রতি পরিবারে এমন সব কনভেন্ট-শিক্ষিতা দিদি-মাসি-পিসি-দিদা ছিলেন যাঁরা নিখুঁত উচ্চারণে ছোটদের বাংলা কবিতা ছড়া শোনাতেন, ডায়েরিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত টুকে রাখতেন, বাংলা সাহিত্যের চর্চা করতেন। তখনও আমাদের ভাঁড়ারে জ্যোতি বসু, সমর সেন, অশোক মিত্র, সত্যজিৎ রায় বা অমর্ত্য সেনের মতো হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র নাম ছিল না, যে নামগুলি দেখিয়ে বলা যেত, ওই ওঁদের দেখো, যখন বাংলা বলেন, একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন না, যখন ইংরেজি বলেন সেও নির্ভুল। এই সে দিন একটি ভিডিয়োতে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে ঝরঝরে নিখুঁত ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার দিতে দেখে অবাক হয়ে ভেবেছি, এই রুচিশীল অনায়াস যাতায়াত কবে থেকে আর নেই… এই নেই-নেই কবে থেকে যেন শুরু হল?

Advertisement

নব্বই দশক থেকে বাংলা মিডিয়াম বনাম ইংরেজি মিডিয়ামের ফারাকটা এক রকম অসেতুসম্ভব ফারাক তৈরি করল। আশির দশকেও মনে পড়ে, ‘বাংলা মিডিয়াম আমি’ ক্লাস ইলেভন-এ ইংরেজি মাধ্যম বান্ধবীদের সঙ্গে সামান্য ঠোকাঠুকির পর সাম্যে স্থিত হয়েছিলাম, হীনম্মন্যতা কেটে গিয়েছিল। এখনকার বাংলা আর ইংরেজি মিডিয়ামের মধ্যে বোধ হয় আর মিলমিশ হয় না।

আমরাই দায়ী। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে ইংরেজি বলতে শিখেই আমরা ভুলে যেতে চেয়েছি পিকক রিডার্স-এর ছোপ-ছোপ কালিমাখা সরকারি দুঃস্থতাকে। দিল্লি-মুম্বই-পঞ্জাব-রাজস্থানে চাকরি করে করে সড়গড় হয়েছি হিন্দি বলতে। নিজের ছেলেমেয়েকে নামকরা ইস্কুলে পাঠিয়ে বলেছি, ‘ওদের বাংলাটা ঠিক আসে না’, ‘ওরা বাংলা বই পড়তেই চায় না’। পাশাপাশি ক্রমশ সামাজিক ভাবে বাংলা হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাষা। নিজেদের দিকে না তুলে অর্থনৈতিক বাধ্যতা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিকে আঙুল তুলেছি। ভিলেন বানিয়েছি জে কে রোওলিং-কে, নিজেদের নয়। কেন তিনি হ্যারি পটার লিখে ফেললেন, তাই তো বাচ্চারা আর ঠাকুরমার ঝুলি পড়ে না। জন্মদিনের উপহারে বাংলা বই দেওয়া ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে। কম দামি, কম চকচকে, অনাকর্ষক সে সব রূপকথা, বাচ্চারাই মুখ ভার করে সরিয়ে দিয়ে মাকে বলেছে, মাআআআ, দেখো না, আন্টি বাংলা বই প্রেজ়েন্ট করেছে… সোজা কথা, তাদের বাংলাকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছি।

নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরে, এই মায়াক্রন্দনের দ্বিচারিতা বাঙালির ঘুচবে কবে? বলুন তো, কে বা কত জন নিজের ছেলেমেয়েকে বা নাতি-নাতনিকে ভাল বাংলা বই কিনে দিয়েছেন? বাংলা কবিতা বলেছেন তাদের সামনে? বাংলা গান বা বাংলা ছড়া শিখিয়েছেন তাদের?

একদা বাংলা ছিল ব্যাপক ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়ে, বিহার ওড়িশা অসম অবধি বিস্তৃত। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের মাথার মণি সাহিত্যিক, জন্ম নিয়েছেন ভাগলপুরে। আজ রাঁচির বাংলা স্কুল ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে থাকে। সেই কবে, ১৯১২ সালে অসম ও বিহার প্রদেশ তৈরি হল, ১৯৩৬ সালে ওড়িশার জন্ম হল ভাষাভিত্তিক মান্যতার দাবিতে। অন্য দিকে স্বাধীনতার মুহূর্তে পুব বাংলা টুকরো হয়েই ভাষা নিয়ে লড়াই করে তৈরি করল বাংলাভাষীদের নিজস্ব দেশ বাংলাদেশ।

আর এ দিকে, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কিন্তু রয়ে গেল প্রান্তিক ভারতীয়ের মনস্তাত্ত্বিক অবক্ষয় নিয়ে। সে কেবলই ‘ভিক্টিম’, অন্যেরা সবাই ‘ভিলেন’। কেবলই সে অন্যকে দোষ দেয়, আর ক্রমশ কোণঠাসা হয় বাংলা ভাষা। অসমে অসমিয়া ভাষার সম্মান, ওড়িশায় ওড়িয়ার গরিমা দেখলে তফাত বোঝা যায়। ওই রাজ্যগুলির লড়ে নেওয়া ভাষাসত্তা যত রমরমিয়ে ওঠে, তত বাঙালির ভাষা গরিমা অস্তমিত হয়। আমাদের থেকে যায় অতীতচারণা। নিজেদের যাবতীয় দুরবস্থার জন্য অবাঙালিকে দোষ দেওয়া হয় আমাদের বর্তমান বিলাস।

পরের প্রজন্ম তাই এই ‘বেচারা বাঙালি’র ছাপছোপ তুলে ফেলতে বদ্ধপরিকর। ঝাঁ-চকচকে সর্বভারতীয় হওয়ার জন্য ক্রমাগত হিন্দি ইংরেজি বলে চলে। অবশ্য সবাই নয়। নয়তো আজও বাংলায় কবিতা লেখা হয় কী করে, ফিল্মই বা কেন তৈরি হয়?

তবু অধিকাংশের এই নিরুপায়তা কেন? বাংলা মানে গরিব আনস্মার্ট অক্ষম কেন? কয়েকটা কারণ ভেবে দেখার আছে। এক, সত্তর-আশির দশকগুলোয় বাঙালির ভাবমূর্তি, বাংলার অর্থনীতির দুর্দশা। আশির দশকের মুখে নিম্ন বুনিয়াদি স্তরে ইংরেজি তুলে দেওয়ার ভুল শিক্ষানীতি। দুই, ক্রমশই বাংলার বুকে চাকরির অপ্রতুলতা, এমনকি উচ্চশিক্ষার জন্যেও বাইরে যেতে বাধ্য হওয়া, চাকরির জন্য তো বটেই। তিন, যে প্রজন্ম বিজ্ঞানপ্রযুক্তির স্বর্গে আরোহণ করেছে তাদের চোখে কেবলই শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত বাংলার অপ্রাসঙ্গিকতা।

আজকের বাঙালি ছেলেমেয়েরা হিন্দিতে ফণীশ্বরনাথ রেণুও পড়েনি, ইংরেজি ক্লাসিকেরও ধার ধারেনি। তবু বাংলাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। আসলে ভাষাকে ভালবাসাটা ভেতর থেকে গজাতে হয়। বাবা মা ও পরিবারের মদত না পেলে কোনও বাঙালি বাংলাকে ঘৃণা করতে শেখে না। আত্মবিস্মৃত বাঙালির শুধু বাংলাকে মনে পড়ে হিন্দির আগ্রাসন এগিয়ে এলে। খুব বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো? এর পর আমরা এই সহজ সত্যটাও ভুলে যাব যে ভারতে ‘জাতীয় ভাষা’ বলে কিছু নেই, ভারতের সংবিধান যে বাইশটা ভাষাকে ‘সরকারি কাজের ভাষা’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, সে তালিকায় জ্বলজ্বল করছে বাংলাও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement