ছবি: সংগৃহীত
উন্নত দেশগুলি এখন কয়লা পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন বন্ধ করছে পরিবেশ আন্দোলনের চাপে। আর ভারত? ভারত সরকার ২০১৯ সালে কয়লার ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন করেছে, এবং এ বছর ৪১টি নতুন কয়লা ব্লকের দরপত্র ডেকেছে। এর মধ্যে ১৪টি ব্লক ঘন জঙ্গলের ভিতর। জঙ্গলের ভিতরে বা কাছে রয়েছে অনেক আদিবাসী গ্রাম। দেশের আইন অনুযায়ী, ঘন জঙ্গলে খনন কার্যের জন্য তিনখানা ছাড়পত্র লাগে— পরিবেশের, বনের এবং স্থানীয় (আদি) বাসিন্দাদের। আশ্চর্য, কোনও ছাড়পত্র ছাড়াই এই দরপত্র ডাকা হয়েছে। অর্থাৎ এটা স্থির হয়েই রয়েছে যে যেন-তেন-প্রকারেণ জঙ্গলের মধ্যে খননকার্য হবেই। প্রয়োজনে আইন শিথিল করে, লোকালয়ের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে। কিংবা ধরে নিতে হয় যে কাজ হবে কি হবে না, এই ধোঁয়াশার মধ্যে থেকেও বিনিয়োগে শামিল হবে বিভিন্ন সংস্থা।
সরকারের কথা হল, দেশের নিজস্ব সম্পদের ব্যবহার বাড়াতে হবে, যাতে আমদানি কমে। কিন্তু তা করতে গিয়ে পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য যদি বিপন্ন হয়, তা হলে বুঝতে হবে পরিকল্পনায় ভুল আছে। তাতে ব্যবসায়িক যৌক্তিকতা থাকতে পারে, দূরদর্শিতা নেই। কয়লাখনি পরজীবীর মতো এলাকার প্রাকৃতিক রস শুষতে থাকে, পরিবর্তে নিঃসৃত করে বিষ। ২০১৩ থেকে ২০১৮-র মধ্যে ওড়িশার ‘মহানদী কোলফিল্ডস লিমিটড’-এর দুটি মাত্র কয়লাখনি থেকে ৬২ লক্ষ কিলোলিটার দূষিত জল নির্গত হয়েছিল, যা ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এ ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে নদী খাল বিলের জলেও দূষণ ছড়িয়েছে, সেখানে মাছ কমে গিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ধীবর সম্প্রদায়ও। আইন বলে, প্রত্যেকটি কয়লাখনিরই খননকার্যের শেষে পরিবেশকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার কথা, জমির উপরের উর্বর মাটি দিয়ে কয়লাখনি ঢেকে গাছ লাগানোর কথা। অথচ, ছত্তীসগঢ়ের সমস্ত কয়লাখনিই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। এ কাজে ব্যবহার হওয়ার কথা ‘ডিস্ট্রিক্ট মিনারেল ফান্ড’ (ডিএমএফ)। তা হচ্ছে না কেন?
এ-ও দেখা যাচ্ছে, এক-একটি এলাকা প্রথমে কয়লাখনির বিপুল রাজস্বের উপরে সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তাই খনির আয়ু ফুরোলে রাজস্বের ব্যাপক ঘাটতিতে এলাকার উন্নয়নই স্থগিত হয় যাচ্ছে। দূষিত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পড়ে থাকছে না এলাকাবাসীর জন্য। অথচ খনির কাজ বন্ধ হওয়ার পর সেখানকার পরিবেশ পুনরুজ্জীবনের কাজে এলাকাবাসীকে শামিল করিয়ে তাঁদের জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা করানোর কথা রয়েছে, যাতে খননকার্যের উপর নির্ভরশীল মানুষগুলি হঠাৎ অর্থসঙ্কটে না পড়েন।
নতুন খনি চালু হলেই উন্নয়নে জোয়ার আসবে এবং ২.৮ লক্ষ নতুন চাকরি তৈরি হবে, এটাও মানা কঠিন। ২০১৫ সালে ৮০টি কয়লাখনি নিলামের সময়ও দাবি করা হয়েছিল যে এর ফলে ১.২ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব আসবে। এল মাত্র ৫৫০০ কোটি টাকা। ১৫টির বেশি খনি চালানোই যায়নি। কেন? আসলে এমন এক সময়ে বিদেশি বিনিয়োগের আশা দেখানো হচ্ছে যখন বিশ্বে কয়লা শিল্পের অবস্থা খারাপ। জাপানের কিছু ব্যাঙ্ক ছাড়া প্রায় আর কেউই এই ধরনের শক্তি উৎপাদনে সহায় হতে চাইছে না। এখানে চুক্তি বেশ কঠিন— সরকার চাইলে বিনা কৈফিয়তে নিলাম বাতিল করে দিতে পারে। সম্ভবত সরকারের ঘনিষ্ঠ কোম্পানিগুলি ছাড়া আর কেউই এই চুক্তিতে রাজি হবে না।
অনেক দশক ধরেই বহু সংস্থা নিজেদের স্বার্থে বেআইনি ভাবে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করেছে। অথচ আজ যারা বেআইনি, কাল তারাই যাতে বৈধতার রক্ষাকবচ পায়, বর্তমান সরকারের নজর যেন সেই দিকেই। খসড়া ‘এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০২০’ দেখলেই তা পরিষ্কার হয়। এর ফলে যে কোনও সংস্থা আগে কাজ শুরু করতে পারে, পরে পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে ছাড়পত্রের আর্জি জানালেই চলবে, তা পেয়েও যাবে। এর আগে প্রকৃতি ও পরিবেশ কখনও এমন ভাবে বিপদের সম্মুখীন হয়নি। সংবাদমাধ্যমের সামনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিজেই ঘোষণা করলেন, প্রকৃতি সংরক্ষণকারী আইন নাকি দেশের অগ্রগতির পথে বাধা! শিল্পায়ন প্রকল্পকে ছাড়পত্র দিয়ে নিজেদের বাহবা দিল বর্তমান পরিবেশ মন্ত্রক! প্রতিবাদের কণ্ঠ আগেও রুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু আঁটঘাট বেঁধে আইনগত ভাবে সেটা করার এমন দৃঢ় পরিকল্পনা হয়নি।
আর এ সব কাজ এমন একটা সময় হচ্ছে, যখন ঠিক উল্টোটাই হওয়া দরকার। কন্টাজিয়ন বলে এত চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছিল, জঙ্গল কাটা মানেই নতুন নতুন ভাইরাসকে আহ্বান করা। অসচেতনতা ও অদূরদর্শিতা আমাদের ভুল পথে নিয়ে চলেছে, তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। তাও শিক্ষা হচ্ছে না?
দ্য ইউনিভার্সিটি অব ট্রান্সডিসিপ্লিনারি হেলথ সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি, বেঙ্গালুরু