কাঠুয়া গ্রামের মেয়েটি এ বার বুঝি চোখ মেলে চাইবে!

মায়ের হাতের রান্না করা খাবার ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আত্মজার পথ চেয়ে থাকা মায়ের প্রতীক্ষায় সে দিন অস্থির জলোচ্ছ্বাস। ঘরময় বাবার উচাটন পায়চারির নিঃসঙ্গ শব্দ। লিখছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য১০ জানুয়ারি, ২০১৮। ভারতবর্ষের মানচিত্রের একেবারে উপর থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তের স্রোত যেন সমগ্র দেশের হৃদয়কে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ০২:২৩
Share:

প্রতীকী ছবি।

পাঠানকোট আদালতের রায়ে কবরের ধুলো মেখে লুকিয়ে থাকা কাঠুয়া গ্রামের সেই ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটা প্রাণপণে এত দিনে মুখ তুলে দেখতে চাইল কুঁড়িরা ফুটেছে কি না, অঙ্কুর মাথা তুলেছে কি না, গুটিপোকার খোলস ছিঁড়ে প্রজাপতি পাখা মেলেছে কি না। তার বেঁচে থাকার সহজাত অধিকার যারা পেশিশক্তির জোরে অকালে ছিনিয়ে নিয়েছিল, এই বিশ্ব সংসারের প্রতিটি আনাচকানাচে কড়া নাড়িয়ে সে তাদের বিচার চেয়েছিল। তার ছোট্ট দু’টি নরম হাত খোলা আকাশের দিকে ছুড়ে জগজ্জননীর কাছে সে যেন চিৎকার করে জানতে চেয়েছিল, “মা গো... এমনি করে কি জীবনের যত মূল্যের বিনিময়ে বারবার কালো মৃত্যুকে হবে কেনা!” শুধু সেই ছোট্ট শিশুটি নয়, কাঠুয়ার জঙ্গলের বিপুল বৃক্ষরাশি, পক্ষীকুল, কীট, পতঙ্গ সবাই যেন ন্যায় বিচারের অনন্ত প্রতীক্ষায় এত দিন স্তব্ধ হয়ে ছিল।

Advertisement

১০ জানুয়ারি, ২০১৮। ভারতবর্ষের মানচিত্রের একেবারে উপর থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তের স্রোত যেন সমগ্র দেশের হৃদয়কে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। মাঘসন্ধ্যার হিমেল কুয়াশা পাহাড়ের শরীরের ওম কাটিয়ে ডানা ঝাপটে বেড়িয়ে পড়ার আগেই ঘোড়াগুলো ঠিক পথ চিনে ঘরে ফিরে এসেছিল। পশ্চিমের সূর্যের মুখাবয়ব পাহাড়ের মায়াবী গহ্বরে ঢলে পড়ার প্রাকমুহূর্ত অবধি রাঙা আভায় চকচক করছিল। মায়ের হাতের রান্না করা খাবারটা ততক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আত্মজার পথ চেয়ে থাকা মায়ের প্রতীক্ষায় সে দিন যেন প্রবল অস্থির জলোচ্ছ্বাস। শীতের কনকনানি ছাপিয়ে ঘরময় বাবার উচাটন পায়চারির নিঃসঙ্গ শব্দ। সঙ্গী ঘোড়াগুলোও উৎকণ্ঠার আতস চোখে চেয়ে রয়েছিল পাহাড়ি ঝর্ণার তালে বেজে ওঠা ছোট্ট পায়ের নূপুর ধ্বনির অপেক্ষায়। তবু মেয়ে ঘরে ফিরল না। পাড়াপড়শিদের নিয়ে জঙ্গল ঢুঁড়ে তন্নতন্ন করে খোঁজাও বিফলে গেল ভোরের কুয়াশামাখা সূর্যের লাল টকটকে হাত ধরে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ যেন উৎকণ্ঠার আগ্নেয়গিরি বুকে চেপে প্রহর গোনা। জানুয়ারি ১৭, ২০১৮-র মেঘলা সকাল। মেঘেরাই যেন খবরটা উড়িয়ে দিল এই পৃথিবীর আকাশে, বাতাসে, মানব মননের মস্তিষ্কের প্রান্তরে, প্রত্যন্ত শিরায়-উপশিরায়। সে দিন কাঠুয়া গ্রামের কোণে কোণে আছাড় খেয়েছিল মধ্যবয়সী এক দম্পতির পাগলপারা আর্তচিৎকার। গভীর জঙ্গলের ঝোপের মাঝে পড়ে থাকা মাত্র আট বছরের ছোট্ট হাসিনার (কল্পিত নাম) ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের সন্ধান অবশেষে পাওয়া গেল। কিন্তু বিঁধিয়ে দিয়ে গেল সহস্র কোটি প্রশ্নবাণের শরশয্যায় আমাদের এই ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থার চালচিত্রের কাঠামোকে। আরও এক বার বেরিয়ে পড়ল নগ্ন কঙ্কাল এই সমাজের অন্তঃপুরের। স্পষ্ট দৃশ্যত হল, ধুয়ে মুছে যাওয়া সব, সমাজের সাজসজ্জা, চাকচিক্য, প্রগতির মণিমাণিক্যে গাঁথা সমাজ-জীবনের সকল শপিং মল আর বিনোদন ভূমির অবাধ চারণক্ষেত্র।

জম্মু শহর থেকে প্রায় ৭২ কিলোমিটার পূর্বে কাঠুয়া গ্রামে সেই ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটার বাস। হাসিনারা মুসলমান যাযাবর মেষপালক সম্প্রদায়ভুক্ত, যারা তাদের ঘোড়া, ভেড়া, নিয়ে হিমালয় চষে বেড়ায়। এই সম্প্রদায়ের মানুষদের ‘গুজ্জর’ বলা হয়। ১০ জানুয়ারি দুপুরে জঙ্গল থেকে ঘোড়াগুলোকে ফিরিয়ে আনতে যাওয়ার পর থেকেই হাসিনা নিখোঁজ হয়। তার নিখোঁজ হওয়ার দু’দিন পরে পরিবারের তরফ থেকে জম্মুর হীরানগর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হলেও পুলিশ প্রাথমিক ভাবে যথেষ্ট সহানুভূতি ও গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টাকে দেখতে চায়নি। একটি ছোট্ট শিশু এ ভাবে নিখোঁজ হওয়ার খবর চাউর হতেই গুজ্জর সম্প্রদায়ের মানুষেরা তীব্র প্রতিবাদে শামিল হন এবং প্রতিবাদস্বরূপ একটি ব্যস্ত সড়ক অবরোধ করে রাখেন। ফলস্বরূপ, হীরানগর থানা বাধ্য হয়ে হাসিনার নিখোঁজ কেস নথিভুক্ত করে (FIR No 10/2018 U/S 363 RPC) এবং হাসিনার সন্ধানের জন্য দু’জন পুলিশ অফিসারকে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্যি যে, এই কাজে নিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের পরবর্তীকালে হাসিনাকে খুন ও ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। হাসিনার ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধারের ছ’দিন পরে জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, মাননীয়া মেহেবুবা মুফতি, ঘটনার তদন্তভার জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের হাতে ন্যস্ত করেন। ক্রাইম ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাভিদ পীরজাদার নেতৃতে একটি তদন্তদল গঠন করে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়। ক্রাইম ব্রাঞ্চ তদন্তে নেমে এই ঘটনায় মোট আট জনকে গ্রেফতার করে, যাদের মধ্যে এক জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার, চার জন কর্মরত পুলিশ অফিসার এবং এক জন নাবালক। এই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ আদালতের কাছে চার্জশিট পেশ করতে গেলে জম্মু আদালতের একশ্রেণির উকিল অভিযুক্তদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে শামিল হয় এবং পুলিশকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করার কাজে বাধা দিতে চেষ্টা করে। এরই মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর তৎকালীন জোট সরকারের সঙ্গী দলের দুই মন্ত্রী অপরাধীদের সমর্থনে মিছিলেও পথ হাঁটেন! যদিও নাগরিক সমাজের তীব্র সমালোচনা ও ধিক্কারের পরিপ্রেক্ষিতে ওই দুই মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। সুযোগ বুঝে কেউ কেউ আবার এই বর্বরচিত নারকীয় গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়েও ধর্মীয় মেরুকরণের উস্কানিতে মেতে ওঠেন!

Advertisement

১১ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের দ্বারা আদালতে দাখিল করা চার্জশিট থেকে জানা যায় যে, ১০ জানুয়ারি অপহরণ করার পর স্থানীয় একটি মন্দিরের পাশের ঘরে হাসিনাকে আটকে রেখে অপরাধীরা তার ওপর দিনের পর দিন বর্বরোচিত অত্যাচার করে। এমনকি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নিষ্পাপ শিশুটিকে অচৈতন্য করে তিন দিন ধরে অপরাধীরা তাকে গণধর্ষণ করে। মৃত্যুকে নিশ্চিত করতে অপরাধীরা মৃত্যুর পরেও পাথর দিয়ে তার মাথায় দু’বার আঘাত হানে।

অবশেষে, গত ১০ জুন, ২০১৯ তারিখে পাঠানকোটের বিশেষ আদালত ছ’জন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে। এই ছ’জন অপরাধীর মধ্যে আদালত এক জন কর্মরত পুলিশ অফিসার এবং এক জন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার-সহ মোট তিন জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন এবং বাকি তিন জন অপরাধীকে যারা প্রত্যেকেই কর্মরত পুলিশকর্মী, পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। এক জন অভিযুক্ত প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পায় এবং নাবালক অভিযুক্তের বিচার করার কথা জুভেনাইল আদালতের, যা এখনও শুরু হয়নি।

হাসিনা আমার মেয়ে। হাসিনা আপনার মেয়ে। প্রকৃতির আস্কারা এবং পড়শিদের আশীর্বাদে বেড়ে ওঠা হাসিনা বিশ্ব নাগরিকদের সকলের মেয়ে। হাসিনা শুধু একটি গুজ্জর বালিকা নয়; হাসিনা মুসলমান নয়; হিন্দুও নয়। হাসিনা খ্রিস্টান বা শিখও নয়। হাসিনা একটি নিষ্পাপ মুখাবয়ব; হাসিনা বিশ্বমানবতার শক্তিতে ভর করে বেড়ে ওঠা এক নিষ্কলুষ নাম। তাকে বেড়ে ওঠা থেকে বঞ্চিত করার দায় আমাদের সকলেরই। তাই তার উপর ঘটে যাওয়া বর্বরচিত নির্যাতনের ন্যায়বিচার চাওয়ার দায়ও আমাদের সকলের।

এত দিনে কাঠুয়া গ্রামে পাহাড় জুড়ে বসন্ত এসে ফিরে গিয়েছে। ধুলোর চাদর সারা শরীরে জড়িয়ে কবরের নীচে গুটিসুটি মেরে সিঁটিয়ে থাকা ছোট্ট শিশুটি এত দিনে বুঝি ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াবে ‘এই আকাশ-ভরা সূর্য তারা’-ময় পৃথিবীর রাজপথে ‘বিশ্ব-ভরা প্রাণ’ নিয়ে!

শিক্ষক, এসআর ফতেপুরিয়া কলেজ, বেলডাঙা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement