গাঁধীর উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল বিশ্বভারতী

গাঁধীজি বিশ্বভারতীর প্রসঙ্গ টেনে জানান, গুরুদেবের এই মহার্ঘ সম্পদ তাঁর কাছে সুরক্ষিত আছে। তিনি তা ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তরিত করতে চান। লিখছেন রাজনারায়ণ পাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:১৩
Share:

শান্তিনিকেতনে দু’দিন কাটিয়ে মহাত্মা ফিরে যাচ্ছেন এ বার। যাওয়ার সময় কবি তাঁর হাতে একখানা চিঠি দিলেন, সঙ্গে পরে সময় পেলে পড়ে দেখবার অনুরোধ। এ সেই চিঠি যেখানে তাঁর অবর্তমানে বিশ্বভারতীকে দেখার জন্য কবির অনুরোধ খাম-বন্দি হয়েছিল। এই ভরসায় যে, মহাত্মা হয়তো তাঁর বিশ্বভারতীকে রক্ষায় সচেষ্ট হবেন। কলকাতা হয়ে গাঁধীজিকে যেতে হবে মালিকান্দায়। সেখানে গাঁধী সেবা সঙ্ঘের অধিবেশনে তাঁর যোগ দেওয়ার কথা। ফলে সকাল সকাল বেরোতে হবে শান্তিনিকেতন থেকে।

Advertisement

গাঁধীজি যখন আশ্রম থেকে রওনা দিচ্ছেন, কবি তখন অপেক্ষা করছেন উত্তরায়ণের চিলেকোঠায়। যাওয়ার আগে মহাত্মা দেখা করলেন তাঁর সঙ্গে। এ দেখাই শেষ দেখা। তিনি কাছে আসতেই কবি বললেন, ‘‘শুনলুম, কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি আপনার, সে জন্য দুঃখিত।’’

হাসলেন গাঁধীজি। সেদিন ছিল আবার তাঁর মৌনতা পালনের উপলক্ষ। তখনও মৌনতা চলছে। অনেক চিত্রগ্রাহক-সাংবাদিক ভিড় করেছেন সেখানে। তাঁদের অনুরোধে হাসিমুখে কবির সঙ্গে বসে ছবি তুলতে রাজি হয়ে গেলেন গাঁধীজি। এর পরে বিদায়ের পালা। কবিকে বিদায় জানাতেই তিনি একখানা খাম এগিয়ে দিলেন তাঁর দিকে। সঙ্গে অনুরোধ, ‘‘এর মধ্যে আপনার জন্য কিছু আছে। পড়ে দেখবেন। ইচ্ছা হলে উত্তর দেবেন। আর না দিলে আমি আপনার ইচ্ছে বুঝতে পারব।’’

Advertisement

পায়ে হেঁটে গ্রন্থাগারের পাশ দিয়ে গাঁধীজি যখন এগোচ্ছেন, আশ্রমিকেরা তখন সমবেত সেখানে। করজোড়ে তাঁরাও বিদায় জানালেন মহাত্মাকে। একদল ছেলেমেয়ে গান ধরল—‘‘আমাদের শান্তিনিকেতন... সে যে সব হতে আপন...।’’ গান শেষে চারদিক মুখরিত হল গাঁধীজির জয়ধ্বনিতে।

গাড়িতে উঠলেন তিনি। ছুটে চলল তা বোলপুরের দিকে। সেখানে আয়োজিত এক সভায় সে দিন তাঁর হাতে পাঁচশো টাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল হরিজন তহবিলের জন্য। সভা শেষে পা বাড়ালেন স্টেশনের উদ্দেশে। সেখানে তখন হাজির হয়েছেন কবির সহযোগীরা। তাঁদের বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠলেন গাঁধী। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে চলল কলকাতার দিকে। পিছনে পড়ে রইল জয়ধ্বনি— ‘‘মহাত্মা গাঁধী কী জয়।’’

ফেরার পথে চলন্ত রেলগাড়িতে বসে কবির দেওয়া খামটি খুললেন মহাত্মা। দেখলেন ভিতরে এক চিঠি। চোখ রাখলেন তাতে—

“প্রিয় মাহাত্মাজি, আজ সকালে আপনি বিশ্বভারতীতে আমাদের কাজকর্ম মোটামুটি ভাবে দেখেছেন। এর গুণাবলী সম্পর্কে আপনার কী ধারণা হয়েছে, তা আমি জানি না। আপনি জানেন যে, প্রত্যক্ষ আকৃতিতে এই প্রতিষ্ঠান জাতীয় হলেও আত্মিক দৃষ্টিতে এ আন্তর্জাতিক এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিশ্বভারতী তার সর্বত্তম উপায়ে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আতিথেয়তা পরিবেশন করছে।

এক সঙ্কটময় অবস্থায় আপনি একে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন এবং একে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিলেন। এই বন্ধুকৃত্যের জন্য আপনি আমদের চিরদিনের ধন্যবাদার্হ।

আর এখন শান্তিনিকেতন থেকে বিদায় নেবার আগে আমি আপনাকে সাগ্রহে আবেদন জানাচ্ছি, এই প্রতিষ্ঠানটিকে আপনি নিজ রক্ষনাধীনে গ্রহণ করুন, আর আপনি যদি একে জাতীয় সম্পদ বলে বিবেচনা করেন তবে একে স্থায়িত্বের আশ্বাস দিন। বিশ্বভারতী আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বহনকারী এক জাহাজের মত এবং আমি আশা করি যে, একে রক্ষা করার জন্য দেশবাসীর কাছ থেকে এ বিশেষ যত্ন দাবী করতে পারে।”

বিলম্ব না করে ট্রেনেই কবির চিঠির উত্তর লিখতে বসলেন মহাত্মা—

প্রিয় গুরুদেব, ফেরার সময় আমার হাতে আপনি যে মর্মস্পর্শী চিঠিখানা দিলেন, তা সরাসরি আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে। বিশ্বভারতী অবশ্যই একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠান। নিঃসন্দেহে ইহা আন্তর্জাতিকও বটে। আপনি আমার উপর নির্ভর করতে পারেন। এর চিরস্থায়িত্বের জন্য আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো। দিনের বেলা এক ঘণ্টা করে ঘুমাবার যে প্রতিশ্রুতি আপনি দিয়েছেন, আশা রাখি তা পালন করবেন। শান্তিনিকেতনকে যদিও আমি সর্বদা আমার দ্বিতীয় আবাস বলে গণ্য করে এসেছি, তবু এ বারের ভ্রমণ আগের চেয়ে যেন আমাকে এর আরও কাছে নিয়ে এল। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে আপনার এম.কে. গান্ধী।

চিঠিটি তিনি রবীন্দ্রনাথকে দেওয়ার জন্য সহযাত্রী অমিয় চক্রবর্তীর হাতে দিলেন। তিনিও একই ট্রেনে মহাত্মার সঙ্গে ফিরছিলেন। এর দিন কয়েক পর গাঁধীজি হরিজন পত্রিকায় (২/৩/১৯৪০) তাঁর সে বারের শান্তিনিকেতন ভ্রমণকে ‘তীর্থযাত্রা’ বলে বর্ণনা করলেন। সে সময়ে বিশ্বভারতীর সর্বাঙ্গীন উন্নতিসাধনে কবি-মনের ব্যাকুলতা ও এর ভবিষ্যতের আনিশ্চয়তা সম্পর্কে তাঁর উৎকণ্ঠা গাঁধীজির হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। সে কথা লিখলেন ‘শান্তিনিকেতনে কী দেখলাম’ শীর্ষক সে রচনায়। কঠোর শ্রমে গড়ে তোলা বিশ্বভারতীর ব্যাপারে সে বার উভয়ের মধ্যে অনেক কথা হয়েছিল; তাও যেন কবি অতৃপ্ত রয়ে গিয়েছিলেন। তাই বিদায়কালে মনের কথাটা খামবন্দি করে দিয়েছিলেন আশ্রম-সুহৃদ গাঁধীজির হাতে। আর ‘মহামূল্য’ সে পত্রটি পড়ে মহাত্মার কী মনে হয়েছিল? হরিজনের পাতায় আজও তাঁর সেই অনুভূতি ডানা মেলে আছে। সেখানে লিখেছিলেন : “...এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই যে এর আর্থিক সমস্যার উদ্বেগ থেকে গুরুদেবকে মুক্ত করা উচিত। তাঁর মর্মস্পর্শী আবেদনের উপরে আমি তাঁকে আমার সাধ্যমত সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এই লেখাটি সেই প্রচেষ্টার প্রারম্ভ।” (হরিজন, ২/৩/১৯৪০)

কথা রেখেছিলেন গাঁধীজি। বিশ্বভারতীকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বোধহয় পাওয়া যেত না যদি না গাঁধীজি উদ্যোগী হতেন। তিনিই জওহরলাল নেহরুকে এই প্রচেষ্টায় শামিল করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ যখন দেশের শিক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব নিলেন গাঁধীজি তাঁকে বিশ্বভারতীর প্রসঙ্গ টেনে জানান, গুরুদেবের এই মহার্ঘ সম্পদ তাঁর কাছে সুরক্ষিত আছে। তিনি তা ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তরিত করতে চান। মহাত্মার সেই ইচ্ছে বাস্তব রূপ পেল এর কিছু দিন পরে, যখন সংসদে ‘বিশ্বভারতী অ্যামেন্ডমেন্ট বিল’ উত্থাপন করলেন (২৮/৪/১৯৫১) মৌলানা সাহেব। জনগণের সে সভায় গাঁধীজির ইচ্ছের কথা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করে সে দিন তিনি বলেছিলেন, ‘‘খানিক দেরিতে হলেও আজ আনন্দ হচ্ছে যে এই প্রতিষ্ঠান সংরক্ষণের উপর ভারত সরকারের সিলমোহর পড়লো।”

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মৃত্যু এসে হঠাৎ সেই মহৎ প্রাণ ছিনিয়ে নিয়ে গেলেও, তিনি ‘মৃত্যু চেয়ে বড়’ হয়ে উঠেছেন। আজও তার প্রমাণ রয়ে গিয়েছে শান্তিনিকেতনে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement