যাহা কিছু বৃহত্তর তাহাই মহত্তর, এমন কথা জনসাধারণ ভাবিয়া থাকেন। তাঁহাদের এমন ভাবিতে সচরাচর বাধ্য করা হয়। কী ধর্মে, কী রাজনীতিতে, কী সমাজে— বৃহৎ সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। তাই ক্ষমতায় আসিয়াই উগ্র শাসক মস্ত মস্ত মূর্তি বহু ব্যয় করিয়া গড়িতে থাকেন। প্রচারকার্যের বিজ্ঞাপনেও অপব্যয়ের অন্ত নাই। তথাপি এই দেখনদারির বাহিরে এমন অনেক কিছুই থাকে, যাহা প্রকৃতই মহৎ। বিদ্যাসাগরের জীবন সেই প্রকৃত মহতের উদাহরণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই মানুষটি সংসার-সমাজে কায়িক শ্রম করিতে দ্বিধা করিতেন না। রান্নাবান্না হইতে শুরু করিয়া নানা গৃহিণীপনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এই সকল কার্য সচরাচর ‘ক্ষুদ্র’ বলিয়া বিবেচিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গজ মনীষীদের মধ্যে কত জন আর বিদ্যাসাগরের ন্যায় সংসারের কায়িক শ্রমে অংশগ্রহণ করিয়াছেন? ক্ষুদ্র রান্নাঘরে পরিজনদের জন্য দায়িত্ব সহকারে রামমোহন বা রবীন্দ্রনাথ পাক করিতেছেন, এমন দৃশ্য অকল্পনীয়। বিদ্যাসাগরের ইহজীবনে নিত্যদিনের এই তথাকথিত ক্ষুদ্র কাজগুলি তাঁহাকে ভিতর হইতে মহৎ করিয়াছে। তাঁহার বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান ইহাতে প্রখর হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের বাস্তববোধের অনুরাগী ছিলেন।
কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন বিদ্যাসাগর ছোট ছোট কার্য করিতে পারিতেন বলিয়াই শ্রমের সমমর্যাদা স্বীকার করিতেন। নির্জন স্টেশনে নামিয়া যে বাঙালিবাবুটি ‘কুলি কুলি’ বলিয়া হাঁক পাড়িতেছিলেন, সেই বাঙালিবাবুটির ভারসমূহ বিদ্যাসাগর অনায়াসে বহন করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগরের সেই শিক্ষা, বাঙালি অবশ্য তেমন গ্রহণ করে নাই। তবে, শিক্ষাটি অতীব জরুরি। নিজের কাজ যত সামান্যই হউক, তাহা নিজে করিতে না পারিলে কোনও মানুষ স্বাবলম্বী ও স্বাধীন হয় না। জাতির স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বন এই শ্রমের মর্যাদার উপর নির্ভর করে। বিদ্যাসাগর শ্রমের মর্যাদায় বিশ্বাস করিতেন বলিয়াই চাকরি ছাড়িতে দ্বিধা করিতেন না। চাকরি না থাকিলে এই শিক্ষিত মানুষটি আলু বিক্রয় করিয়া জীবনযাপনের কথা ভাবিতে পারিতেন। শ্রমবিভাজনের আর একটি ক্ষেত্র আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয়। পুরুষের কার্য ও রমণীর কার্য পৃথক বলিয়া সেখানে নির্দিষ্ট। এই অলীক লিঙ্গ নির্ধারিত শ্রমবিভাজনকে মাতৃবৎসল বিদ্যাসাগর অস্বীকার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তাঁহার মধ্যে মাতৃহৃদয়ের প্রকাশ দেখা যায়। তিনি এক দিকে যেমন শ্বেতাঙ্গদের দম্ভকে প্রশ্ন করিতে পারিতেন, অপর দিকে তেমন কাঁদিতে পারিতেন। বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস রচনায় রাম থাকিয়া থাকিয়া অশ্রুবিসর্জন করিয়াছেন। এই অশ্রুবিসর্জনে নাকি রামের রামত্ব নাশ হইয়াছে। পুরুষ নায়ক তিনি বীর, যুদ্ধ করিবেন ক্রন্দন করিবেন না। বিদ্যাসাগরের চরিত্রে ভগবতী দেবীর প্রভাব অপরিসীম। তাই তিনি কাঁদিতে পারেন। এই ক্রন্দনশীল পুরুষ মাতার ন্যায় স্নেহপ্রবণ— দীন, দরিদ্রকে সহায়তা করেন। নিজ হস্তে সাঁওতালদের পরিবেশন করিয়া তাঁহাদের নিকটজন হইয়া উঠেন। নারীত্বের ও মাতৃত্বের এই কায়িকবৃত্তি পালন করিয়া তিনি কেবল লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনকেই তুচ্ছ করিলেন না, নিজের সংবেদনশীলতাকেও সম্প্রসারিত করিলেন। বিধবা রমণীর শরীরযাতনার সঙ্গত দাবি যে বিদ্যাসাগর অনুধাবন করেন, অথবা নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যে বিদ্যাসাগর ঘোষণা করেন, সেই বিদ্যাসাগর তাঁহার ক্ষুদ্র কার্যের অনুশীলনের উপরেই এই বৃহৎ কার্যাবলি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। তাঁহার ক্ষুদ্র কার্য ও বৃহৎ কার্য, দুইয়ের সামঞ্জস্যেই তাঁহার অপরিসীম মহত্ত্ব প্রকাশিত।
নিত্য ও আপাত ক্ষুদ্রের এই জগৎকে আমরা স্বীকার করি না বলে, আমাদের গৃহের সহিত আমাদের বাহিরের দূরত্ব তৈরি হয়। আমাদের রাজনীতি ও সমাজনীতি কেবল দেখনসর্বস্ব কতকগুলি বড় বড় কথার সমষ্টি হইয়া উঠে। বিদ্যাসাগর পরকালে বিশ্বাসী ছিলেন না। অনেকে বলিতেন, তাঁহার দানধর্মের জন্য তিনি অক্ষয় স্বর্গবাস করিবেন। শুনিয়া বিদ্যাসাগর হাসিতেন। ইহাই তাঁহার প্রকৃত হাসি। তিনি বৃহৎ স্বর্গের জন্য কিছু করেন নাই। স্বর্গের লোভ তাঁহার ছিল না বলিয়াই তিনি সহজ ও সৎ থাকিতে পারিয়াছিলেন, ক্ষুদ্রকে ক্ষুদ্র বলিয়া না দেখিয়া, তাহাদের প্রয়োজনীয় ও যথার্থ বলিয়া ভাবিতে পারিয়াছিলেন। আমাদের রাজনীতি ও সমাজনীতিতে ছোটর প্রতি তুচ্ছের এই মমত্ব ও গুরুত্ব যে-দিন স্বীকৃত হইবে, সেই দিনই বৃহতের ভুল স্বর্গ হইতে আমরা মুক্তি পাইব।