সম্পাদকীয় ২

ভরসা

ব্যক্তিই পারে গোষ্ঠীকে চেতনায় ফিরাইয়া আনিতে। আপাতত ব্যক্তির এই ক্ষমতাটুকুই ভারতের ভরসা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৯ ০০:০৭
Share:

দেশের দুই প্রান্তে দুইটি মানবিক ঘটনা সংবাদ শিরোনামে আসিয়াছে। দেশের সম্প্রীতিকামী মানুষ তাহাতে আশার আলো দেখিতেছেন। প্রথম ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের। রমজান মাসে রোজা রাখিতেছিলেন কালীগঞ্জের ছোট কুলবেড়িয়া গ্রামের ওসমান গনি শেখ। কিন্তু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এক অপরিচিত বালিকা রেখা দাসের জন্য রক্তদান করিতে গিয়া তিনি রোজা ভাঙিয়াছেন। দ্বিতীয়টি জম্মু ও কাশ্মীরের। পহেলগামের লিডার নদীতে র‌্যাফটিং করিতে গিয়া ঝোড়ো হাওয়ায় পর্যটকদের একটি নৌকা উল্টাইয়া যায়। নদীতে ঝাঁপাইয়া মণীশকুমার সরাফ, শ্বেতা সরাফ-সহ পাঁচ পর্যটকের প্রাণ বাঁচাইয়াছেন পেশাদার গাইড রউফ আহমদ দার। যদিও নিজে বাঁচিতে পারেন নাই। ঘটনা হইল, বিপদের কালে দেশের দুই প্রান্তে দুই জন মানুষ সহনাগরিকদের পাশে দাঁড়াইয়াছেন। মনুষ্যত্বের জন্য ইহা নিঃসন্দেহে উচ্ছ্বাসের। কিন্তু, সেই মনুষ্যত্বের উচ্ছ্বাসেই এই আখ্যান ফুরাইয়া যায় না। ভারতের বর্তমান সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষিতে এই ঘটনা দুইটিকে ব্যক্তিমানুষের উত্তরণ হিসাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
২০১৪ সাল হইতে যে তুমুল অসহিষ্ণুতা ভারতের অভিজ্ঞান হইয়াছে, তাহার ধারা এখনও অব্যাহত। অসম হইতে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান— দেশের নানা প্রান্তে গত কয়েক মাসেই এমন সব ঘটনা ঘটিয়াছে, যাহাতে প্রত্যয় হয়, ভারতীয়রা ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচিতির বাহিরে দেখিবার সামর্থ্য হারাইয়াছে। দুই অপরিচিত ভারতীয়ের সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা পরস্পরকে মানুষ হিসাবে না দেখিয়া ধর্মীয় পরিচয়ে দেখেন, এবং সামাজিক পরিসরে ধর্মদ্বয় যুযুধান হইলে তাঁহারাও পরস্পরকে শত্রু জ্ঞান করেন। এই ধারণাটি যে সামগ্রিক, কৌম স্তরে ভুল, এমন দাবি করিবার উপায় ভারত রাখে নাই। কিন্তু, এখানেই কৌমের সহিত ব্যক্তির ফারাক। ওসমান বা রউফ দেখাইয়া দিয়াছেন, সামগ্রিক বৈর ব্যক্তি-এককের মূল্যবোধকে সর্বদা প্রভাবিত করিতে পারে না। ব্যক্তি-স্তরে গুরুত্ব পাইতে পারে অন্যতর বিবেচনা। যেমন, সহনাগরিকের প্রাণ বিপন্ন হইলে তাঁহার এবং নিজের ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনা না করিয়াই ব্যক্তি তাঁহার প্রাণ বাঁচাইতে নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস, এমনকি জীবনও বিসর্জন দিতে পারে। এই বিন্দুতেই ওসমান বা রউফের উদাহরণগুলি অমূল্য। কৌম যখন বৈরের সাধনায় অন্ধ, তখন ব্যক্তিই পারে সম্প্রীতির সূত্রগুলি জুড়িয়া লইতে।
প্রশ্ন উঠিতে পারে, ওসমান বা রউফ যখন সুস্থ মনুষ্যত্বের তাগিদেই অপরের প্রাণ বাঁচাইতে ঝাঁপাইয়াছেন, তখন সেই আখ্যানে তাঁহাদের ধর্মীয় পরিচয় আরোপ করা কেন? যাঁহারা মনুষ্য পরিচয় লইয়া অপরের বিপদে পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছেন, তাঁহাদের ধর্মের গণ্ডিতে বাঁধিয়া ফেলিলে সেই পরিচিতিকেন্দ্রিক রাজনীতির পরিসরেই প্রবেশ করিতে হয় না কি? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। তাহা ভারতের বর্তমান সামাজিক অন্ধকারটিকেও দেখাইয়া দেয় বটে। কিন্তু, সমষ্টিগত স্তরে মানুষ যখন বিভেদের সাধনায় মত্ত, তখন ব্যক্তির প্রতিস্পর্ধী অবস্থানকে তাঁহাদের ধর্মীয় পরিচয় হইতে বিচ্যুত না করিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা জোরের সঙ্গে বলা চলে— গোষ্ঠী আসলে ব্যক্তিমানুষের সমাহার, কোনও একশৈল অস্তিত্ব নহে, এবং ব্যক্তিই পারে গোষ্ঠীকে চেতনায় ফিরাইয়া আনিতে। আপাতত ব্যক্তির এই ক্ষমতাটুকুই ভারতের ভরসা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement