বাজেট এসেছে এবং চলে গিয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ রুটিনমাফিক বেড়েছে
শিক্ষাক্ষেত্রে এনডিএ সরকার গত পাঁচ বছরে যে ভীষণ মনোযোগী হয়েছে, তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও প্রমাণ নেই। অন্তত সরকারপক্ষ তেমন প্রমাণ পেশ করার কোনও আগ্রহও দেখায়নি। বাজেট এসেছে এবং চলে গিয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ রুটিনমাফিক বেড়েছে। আবার কখনও বা এমনও হয়েছে— যেটুকু বাড়ল তাও পুরো খরচ হল না। গত বছরের (২০১৯-২০) বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৩,৮৪৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত খরচের হিসেবে ওই বছরের সংশোধিত অনুমিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৩,৬২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বলা যায় ২০১৮-১৯-এর এই সংশোধিত অনুমিত ব্যয় থেকে পরের বছরের বাজেট বরাদ্দ বেড়েছিল ১৩.৪ শতাংশ। দু-এক দিনের মধ্যেই জানা যাবে ২০২০-২১-এর জন্যে এই হিসেবটা কেমন দাঁড়ায়।
শিক্ষাক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে এই ‘সংশোধিত অনুমিত ব্যয়’ প্রায়শই সে বছরের বাজেট বরাদ্দ থেকে কম হয়ে যাচ্ছে, ফলে সেখান থেকে ধরে পরের বছরে বাজেট বরাদ্দ কত বাড়ল তা শতাংশ হিসেবে বেশ বড় দেখালেও হরেদরে খরচ যে খুব বাড়ছে না সে ব্যাপারটা প্রায় চোখের আড়ালেই থেকে যায়। কয়েক বছরের সংখ্যাগুলি পরপর সাজালে তবেই তা বোঝা যায়, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় স্বভাবতই যা থাকে না।
মোট জাতীয় আয়ের শতাংশ হিসেবে দেখলে শিক্ষাক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মিলিত ব্যয় গত পাঁচ বছর ধরেই ২.৮ থেকে ৩.০-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই যা তিন-এর অনেক উপরে। এ পর্যন্ত ভারতবর্ষে যতগুলি শিক্ষা কমিশন হয়েছে, সবাই একবাক্যে বলেছে— জাতীয় আয়ের অন্তত ছয় শতাংশ শিক্ষায় খরচ করা উচিত। অনুমান করা যায়, সে সম্ভাবনা সুদূর। সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় শিক্ষা যে পড়ে না তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
২০১৮-র বাজেট বক্তৃতায় অরুণ জেটলি বলেছিলেন, শিক্ষা স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায়– যাদের একসঙ্গে বলে ‘সামাজিক ক্ষেত্র’– বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে যে ‘ফিসকাল স্পেস’ দরকার, সরকারের তা নেই। অর্থাৎ সোজা বাংলায় বললে, সরকারের টাকা নেই। বলা বাহুল্য, সর্দার পটেলের গগনচুম্বী মূর্তি নির্মাণের গুরুত্বের কাছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা কিছুই নয়। বাজেটে থাকার মধ্যে থাকে খানকয়েক প্রধানমন্ত্রী অমুক কিংবা তমুক যোজনা। যেমন গত বছর ছিল প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা। ‘কৌশল’ বলতে ‘স্কিল’ বুঝতে হবে, শিক্ষা নয়। এই সে দিন বিমানবন্দরে অত্যুজ্জ্বল সরকারি বিজ্ঞাপনে দেখলাম এই যোজনায় এ পর্যন্ত ৬৯ লক্ষ যুবক-যুবতী উপকৃত হয়েছেন। উপকারের প্রকৃতি সম্পর্কে কিন্তু এর বেশি জানার উপায় নেই। বাজেটে যোজনা ঘোষণার দশ মাসের মধ্যে এই প্রগতি কেমন হল এ প্রশ্নের কে জবাব দেবে? আশা করা যায় এ বারও তেমনই নতুন কোনও যোজনার উল্লেখ থাকবে। অন্য দিকে সর্বশিক্ষা মিশনের অর্থ বরাদ্দ গত ছ’বছর ধরে কমেছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে খরচে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারেরই ভূমিকা রয়েছে। সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদ অনুসারে শিক্ষা ছিল পুরোপুরি রাজ্যের এক্তিয়ারে। ১৯৭৬-এর সংশোধনের পর শিক্ষা এসে গেল যৌথ তালিকায়। কিন্তু অর্থ বরাদ্দের ভাগাভাগির মধ্যে যে ধরণের ভারসাম্য থাকা উচিত ছিল, তা এ যাবত বিশেষ দেখা যায়নি। যেমন, সর্বশিক্ষা মিশনের বরাদ্দ কমেছে কারণ কেন্দ্র চেয়েছে রাজ্যগুলি এ বাবদে বেশি বেশি বরাদ্দ করুক। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন দিতে যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেখানে পরিকাঠামোয় উন্নতির জন্যে অতিরিক্ত বরাদ্দ করতে নাভিশ্বাস ওঠে। সর্বশিক্ষা মিশনের টাকা ফিরে যায় কারণ রাজ্য ‘ম্যাচিং’ বরাদ্দটুকু করে উঠতে পারে না। ফলে কেন্দ্র-রাজ্য ঠেলাঠেলি চলতেই থাকে।
সম্প্রতি চুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষকদের নিয়ে অনেক রাজ্যই যে সঙ্কটে জর্জরিত হচ্ছে তার শিকড়টিও রয়েছে এই ঠেলাঠেলিতে। চুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকেই শুরু হয় বিদ্যালয়মুখী শিশুদের সংখ্যা বাড়তে থাকায়। তার পর ২০০১ সালে সর্বশিক্ষা অভিযান শুরু হলে চুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ আরও সহজ হয়ে গেল। সর্ব শিক্ষা অভিযানের টাকায় স্থায়ী শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যায় না, কিন্তু চুক্তি-ভিত্তিকদের যায়। শিক্ষার অধিকার আইন ২০১০ সালে বলবৎ হলে অল্প সময়ে অনেক শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিল। রাজ্যগুলি ছাত্রপ্রতি শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানোর সহজ উপায় দেখল অল্প বেতনের চুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগে। এখন এই বিপুল সংখ্যক চুক্তি-ভিত্তিক শিক্ষক অনেক রাজ্যকেই রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এমন বেশ কিছু জটিল সমস্যা আছে যার মোকাবিলা করার আশু প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর সদিচ্ছাটুকু থাকতে হবে। বেশ কয়েক বছর ধরেই শিক্ষা বিষয়ে যাবতীয় সরকারি নথিতে ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট’ কথাটি মুহুর্মুহু উত্থাপিত হতে দেখছি। জাতীয় শিক্ষানীতির সাম্প্রতিকতম খসড়াতে ‘স্কিল’ শব্দটি যত বার ব্যবহৃত হয়েছে, শিক্ষা শব্দটি তার ধারেকাছে যেতে পারেনি। বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ছেলেপুলেরা যে কিছুই প্রায় শিখছে না, তা নিয়ে সঙ্গত কারণেই খসড়াতে অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এই উদ্বেগের উপলব্ধি থেকে ‘কৌশল উন্নয়নে’ ঝাঁপ দিয়ে পড়ার নিদারুণ আগ্রহ দেখে উদ্দেশ্য-বিধেয় কেমন যেন ঘুলিয়ে যায়। উন্নতমানের বিদ্যালয়-শিক্ষার যে কোনও বিকল্প হয় না তামাম বিশ্বে তা স্বীকৃত। অধিকাংশ সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে বলে সেখানে ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে সবাইকে তথাকথিত বৃত্তিমুখী শিক্ষায় নিয়ে যেতে হবে— এই নীতিভাবনায় তেমন সারবত্তা নেই।
বৃত্তিমুখী শিক্ষা নিয়ে সরকারি বক্তব্যে যে যুক্তিগুলি পাই তা এ রকম: এক দিকে, বিদ্যালয়ে গিয়েও শিশুরা বিশেষ শিখছে না। ফলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়োগযোগ্যতা তৈরি হচ্ছে না। অন্য দিকে রয়েছে বিশাল অসংগঠিত ক্ষেত্র যেখানে তারা শেষমেশ উপনীত হচ্ছে, যেখানে উৎপাদনশীলতা খুব কম, ফলে মজুরিও কম। অতএব নবম শ্রেণি থেকেই তাদের বৃত্তিমুখী করে তোলার কথা বলা হয়েছে, যার ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়বে আশা করা হচ্ছে।
এই ভাবনার গলদটি হল, যথাযথ গুণমানের শিক্ষার সুযোগের অভাবে যাদের তথাকথিত বৃত্তিমুখী শিক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়া হল, তাদের ভবিষ্যৎ অসংগঠিত অর্থনীতির সঙ্গে চিরতরে বাঁধা পড়ে গেল। অর্থাৎ শিক্ষার যে সামগ্রিক দর্শনটি এত কাল মূলধারার শিক্ষায় ছিল বলে জানতাম, তাকে খণ্ডিত করে ‘কুশলী’ শ্রমশক্তি তৈরিকে লক্ষ্যবস্তু করে তুলেছে সরকার। জানতাম, শিক্ষার সর্বজনীনতা আর্থনীতিক সুযোগের সাম্যের লক্ষ্যে আবশ্যিক ধাপ। এই দর্শনকে সরকার পুরোপুরি উলটে দিয়ে এক ধরণের শ্রেণিবিন্যাসকে পোক্ত করার পথে হাঁটছে।
বাজেটের প্রাক্কালে এই সব তর্ক তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ থাকতে পারে। বাজেটকে যাবতীয় সরকারি নীতিভাবনার মহাভারত হিসেবে দেখার মানেও হয় না। কিন্তু সরকার শিক্ষা বা স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে যে দলিলগুলি প্রস্তুত করে তার সঙ্গে ফি বছরের বাজেট বরাদ্দ ও অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতাকে মিলিয়ে দেখলে একটা ছবি উঠে আসে। গত কয়েক বছরে উঠে আসা ছবিগুলি তেমন ভরসা যোগায় না।
(লেখক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতার অধিকর্তা)
গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ