ছবি— শাটারস্টক।
প্রতি বারই বাজেটে— তা সে রাজ্যেরই হোক বা কেন্দ্রের— ঘাটতি নিয়ে চলে মহা আকচাআকচি। আর আমরা, সাধারণ মানুষ ভাবি— কেন? বাজেট ঘাটতি আর রাজকোষ ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) খায় না মাথায় দেয়? রাজস্ব ঘাটতিটা বা কী? কেনই বা আবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো প্রাথমিক ঘাটতির মতো আরও একটা কী জানি মাঝে মাঝে আলোচনায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে!
আসলে বাজেটের অর্থনীতি যতই জটিল হোক না কেন, গোদা অঙ্কের বিন্যাসটা কিন্তু অত কঠিন নয়। কৌশিক বসু কলকাতায় ফিকির এক অনুষ্ঠানে একটা মন্তব্য করেছিলেন, যার সার অংশটি এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না।
ওঁর কথায়, অর্থনীতির দু’টো অংশ। একটা অংশ কিন্তু সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায়। অন্য অংশটি বুঝতে গেলে অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব বুঝতে হয়। তো এই বাজেটের অঙ্কের অংশটি কিন্তু ওই প্রথম অংশ। সাধারণ বুদ্ধির ব্যাপার। আমি, আপনি বা একজন স্কুলের ছাত্রও বুঝে ফেলবে যদি কোনটা কী তা কেউ বলে দেয়।
তাই এ বার বাজেটের আগেই বুঝে নি গোড়ার ব্যাপারটা। সরকারের আয়ও কিন্তু আমাদের আয়ের মতোই। আমাদের আয় যেমন রোজগার বা মাইনে থেকে আসে, সরকারেরও তেমনই আয় হয় মূলত কর থেকে। যাকে আমরা রাজস্ব বলে থাকি। রাজস্ব খাতে সরকারের আবার আর একটা আয়ের সূত্র আছে। আমরা যদি শেয়ার কিনি তার ডিভিডেন্ড বাবদ আমাদের আয় হয়। মিউচুয়াল ফান্ড থেকেও যেমন আমরা আয় করি, তা ওই বেতন অতিরিক্ত আয় হিসাবে দেখাতে হয় ইনকাম ট্যাক্সের খাতায়। সরকারের বাজেটেও তাই আয়ের সূত্রে থাকে অন্য খাতে আয়ের হিসাব। যা আসে সরকারের নানান সংস্থায় বিনিয়োগের ডিভিডেন্ডের খাতে। তাই বাজেটে আয়ের মূল সূত্র দুটো।
ক) কর বাবদ আয়
খ) অন্য সূত্রে আয়
এর পর আসে মুলধনী আয় বা ক্যাপিটাল রিসিপটস। এই খাতে বিভিন্ন ঋণের হিসাব থাকে। মূলত তিন ভাগে দেখান হয় এই আয়কে:
ক) ফেরত পাওয়া ঋণের টাকা
খ) ঋণ সূত্রের নানান আয়
গ) ঋণ
এই রাজস্ব আয় আর মূলধনী আয় নিয়ে তৈরি হয় সরকারের গোটা বছরের সংসারের হিসাব।
আরও পড়ুন: আর্থিক বৃদ্ধির রাস্তায় ফিরতে গেলে বাজেটে অনেকগুলো স্বচ্ছতা জরুরি
আরও পড়ুন: ‘ভারতবর্ষ কাহিনী’ বিশ্ব লগ্নিবাজারে এখন কাটছে না
একই ভাবে সরকারের সংসারের খরচও বিন্যস্ত থাকে। রাজস্ব খাতে আয়ের হিসাব যায় সেই সব খাতে, যাতে এক বছরেই দায় শেষ। যার থেকে, সাধারণ ভাবে বলা যায় যে, কোনও সম্পদ তৈরি হয় না। যেমন পেনসন, যেমন মাইনে এই সব। এই খাতকে অবশ্য আরও ভাঙা হয়। কিন্তু আমরা তার মধ্যে যাব না।
আর মূলধনী খাতে ব্যয় মানে হল সম্পদ তৈরি। যেমন পরিকাঠামো। এই বছর কাজ শুরু হল, কিন্তু তা এই বছরেই যে শেষ হবে তার কোনও মানে নেই। আর এই খরচের ফলে যা তৈরি হবে তা থেকে দেশ পরিষেবা বা সেবা পাবে আগামী বেশ কিছু বছর। তাই একে মূলধনী খাতে খরচ হিসাব দেখানো হয়।
আপনার আমার সঙ্গে অবশ্য সরকারের একটা বড় ফারাক আছে। আপনি বা আমি যদি আয় দিয়ে খরচ না মেটাতে পারি, তা হলে ধার করতে বাধ্য থাকি। আর তাতেও যদি না পারি তা হলে ঘটিবাটি বিক্রি করি। সরকারের কিন্তু একটা সুবিধা আছে। সরকার নোট ছাপিয়ে খরচ মেটাতে পারে। তবে তাও অনির্দিষ্ট ভাবে করতে পারে না। তা করলে অর্থনীতির বারোটা বাজবে যেমনটি হয়েছিল জিম্বাবোয়ের ক্ষেত্রে। কিন্তু তা অর্থনীতির বৃহত্তর আলোচনা। আজকের বিষয় নয়।
বাজেটের হিসাব খুললে যে চারটি ঘাটতির হিসাব পাই তা হল:
ক) বাজেট ঘাটতি
খ) রাজস্ব বা রেভিনিউ ঘাটতি
গ) রাজকোষ বা ফিসকাল ঘাটতি
ঘ) প্রাথমিক বা প্রাইমারি ঘাটতি
বাজেট ঘাটতি
এই অংশটি সব থেকে সোজা। গোটা বছরে যা খরচ করবে বলে সরকার মনে করে, তার থেকে সব সূত্রে যে টাকা রাজকোষে সরকার ভরতে পারবে তার ব্যবধানই হল বাজেট ঘাটতি। অর্থাৎ
বাজেট ঘাটতি = খরচ - সব সূত্রে আনা আয়
এ বার, বাজেট ঘাটতি = ০ হলে, খরচ = সব সূত্রে পাওয়া আয়
কিন্তু খরচ যদি সব মিলিয়ে আয়ের থেকে বেশি হয়, তা হলে আমরা ঘাটতির বাজেট পাব। এ বার সরকার তা নোট ছাপিয়ে মেটাতে পারে বা বছর চালু হলে অন্য ভাবে তা মেটাতে পারে। কী ভাবে তার মধ্যে না হয় এখন নাই ঢুকলাম।
রাজস্ব ঘাটতি
একই ভাবে রাজস্ব ঘাটতির অঙ্ক করা হয়। রাজস্ব বাবদ খরচ আর রাজস্ব বাবদ আয়ের ব্যবধান থেকে আসে ঘাটতির হিসাব। অর্থাৎ
রাজস্ব ঘাটতি = রাজস্ব খাতে খরচ - রাজস্ব খাতে আয়
রাজস্ব খাতে যদি ঘাটতি না থাকে তার মানে হল যা সরকার আয় করছে তা দিয়েই রাজস্ব খাতের সব খরচ মেটাতে পারছে। কিন্তু
রাজস্ব ঘাটতি >০ হলে, রাজস্ব খাতে খরচ > রাজস্ব খাতে আয়
মানে দাঁড়ায় একটাই— সরকারের যা আয় তা দিয়ে ব্যয় মেটাতে পারছে না। তা হলে উপায় একটাই, ধার। আর এই খানেই আসে রাজকোষ ঘাটতি বা ফিসকাল ডেফিসিটের অঙ্ক। বুঝে নেওয়া যাক সেটা।
রাজকোষ ঘাটতি
রাজকোষ ঘাটতি আর কিছুই নয়, সরকারের ঋণের হিসাব। এর অঙ্কটা হল
রাজকোষ ঘাটতি = সব খাতে খরচ - ঋণ ছাড়া অন্য সব খাত থেকে আয় = মোট ঋণ
এই অঙ্কটা খুব জরুরি। আমরা যখন ঋণ নিতে ব্যাঙ্কে যাই, তখন ব্যাঙ্ক আমাদের কাছ থেকে শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নেয় তাই নয়, আমাদের কাছে কী সম্পদ আছে তারও একটা হিসাব নেয়। তার পর আমাদের ঋণ শোধ করার ক্ষমতার একটা হিসাব করে।
দেশের সরকার যখন ঋণ করে তখন? খেয়াল করে দেখবেন রাজকোষ ঘাটতি একটা শতাংশের হিসাবে প্রকাশ করে থাকে। কার শতাংশ তা নিয়ে অবশ্য আমরা অনেকেই কোনও প্রশ্ন করি না। এটা প্রকাশ করা হয়ে থাকে জিডিপি বা গড় জাতীয় উৎপাদনের অংশে। তার কারণ সরকার যে ঋণ করে তা হল জাতীয় দায়। তা মেটানোর দায়ও কিন্তু আমাদের সকলেরই। সরকার এখানে আমাদের অছি।
আর তাই এত আকচাআকচি এই বিশেষ ঘাটতিটিকে নিয়ে। সরকারের যত ঋণ বাড়বে, তত রাজকোষের দায় বাড়বে। তাই একটা আইন করে কোনও সরকার জাতীয় উৎপাদনের কতটা অংশ ঋণ করতে পারবে তা ঠিক করে দেওয়া আছে। কিন্তু ঠিক কতটা ঋণ সরকার করতে পারে বা করা উচিত তা নিয়ে মতভেদ আছে।
যেমন এখন। দেশে চাহিদার সংকট তৈরি হয়েছে। উৎপাদন কমছে। তা হলে কী করা উচিত। কেউ কেউ বলছেন, সরকার দেশের সব থেকে বড় ক্রেতা। সে যদি খরচ বাড়িয়ে পরিকাঠামো তৈরি করে তাতে নতুন কর্মসংস্থান হবে। বাজারে চাহিদা বাড়বে আর দেশের বর্তমান রুগ্ন আর্থিক হালের সুরাহা হবে। যুক্তি আছে উল্টো দিকেও।
খরচ বাড়লে সরকারকে ঋণ করতে হবে। সরকার ঋণ করলে বাজারে ঋণের দাম অর্থাৎ সুদ বাড়বে। তাতে সাধারণ ঋণের খরচ বাড়বে। যে দেশে লগ্নি এখন সমস্যা সে দেশে ঋণের খরচ বাড়া মানে তো লগ্নির খরচ বাড়া! আর লগ্নির খরচ বাড়লে আর্থিক অবস্থা ঘুরে দাঁড় করানো সমস্যা হয়ে যাবে! মানে শাঁখের কড়াত! আর এই বিতর্কের কারণেই রাজকোষ ঘাটতি সব ঘাটতির মধ্যে নিজের জায়গা করে নিয়েছে আলাদা করে।
প্রাথমিক ঘাটতি
ঘাটতির খতিয়ানে আলোচনার পরিসরে কিন্তু দুয়োরানি এই ঘাটতিটি। অথচ বাজেট আলোচনায় এর গুরুত্ব কম নয়। প্রাথমিক ঘাটতি বা প্রাইমারি ডেফিসিট আসে ঋণ আর সুদ বাবদ খরচ থেকে। কোষাগারের স্বাস্থ্যের হিসাব কষতে কিন্তু এর গুরুত্ব কম নয়।
প্রাথমিক ঘাটতি = ঋণ - সুদ বাবদ খরচ
প্রাথমিক ঘাটতি যদি শূন্য হয় তা হলে—
ঋণ = সুদ বাবদ খরচ
মানে আমরা যা ঋণ করছি তার সবটাই যাচ্ছে সুদ মেটাতে। যুক্তি এগিয়ে নিয়ে গেলে দাঁড়ায়— যা আর্থিক হাল তাতে কোষাগারে সুদ মেটানোর টাকা নেই। ঋণ করতে হচ্ছে ঋণের সুদ চোকাতে।
বাজেট নিয়ে যখন বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় বসেন, তখন কিন্তু কোষাগারের স্বাস্থ্য চটজলদি হিসাব করতে তাঁরা এই ঘাটতিগুলোই দেখে নেন। এই বাজেটে তাই আপনিও দেখে নিন এই অঙ্ক। আর তাল মিলিয়ে যোগ দিন বাজেট আলোচনায়। ৮০ সি সি-ই কিন্তু বাজেটের শেষ কথা নয়। আগামী দিন আপনার কেমন যেতে পারে তার দিশা কিন্তু বাজেটেই মেলে অনেকটাই।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ