গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ।
দেশের অর্থব্যবস্থার এক গভীর সংকটের আবহে এ বারের বাজেট পেশ হতে চলেছে। দুটি প্রশ্ন এই নিরিখে প্রাসঙ্গিক।
প্রথম, এই সংকট থেকে বেরোনোর জন্য সরকারের কী করণীয়?
দ্বিতীয়, ১ ফেব্রুয়ারি বাজেটে সেই পথে হাঁটা সরকারের পক্ষে কি সম্ভব?
অর্থনীতিবিদরা অনেক প্রশ্নেই একমত হন না । এর অবশ্য অনেক কারণ রয়েছে। যার মধ্যে মতাদর্শগত অবস্থান নিশ্চিত ভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবু, ভারতের আর্থিক সঙ্কটটির নেপথ্যে যে চাহিদার সঙ্কট রয়েছে এই বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা মোটামুটি একমত। অর্থাৎ, এই সঙ্কট থেকে বেরোতে হলে বাজারে মোট চাহিদা বাড়াতে হবে। কী ভাবে তা সম্ভব? যদি মানুষ বেশি করে পণ্য কিনতে শুরু করে তবে চাহিদা বাড়বে। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি যে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিম্নগামী। তাই মানুষ চট করে বাড়তি খরচ করতে শুরু করবে তা ভাবা বোকামো হবে। অতএব, বিকল্প পথ খুঁজতে হবে।
যদি বেসরকারি ক্ষেত্র বিনিয়োগ বাড়ায়, তা হলে অর্থব্যবস্থায় চাহিদা বাড়বে এবং সমস্যা অনেকটা কমবে। কিন্তু বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ভারতে বিনিয়োগের হার নিম্নগামী। আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তা, তেলের বাড়তে থাকা দাম, বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় মন্দার ছায়া-সহ বেশ কিছু বিষয় এর জন্য দায়ী। তাই ভারতের পুঁজিপতিরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাড়তি বিনিয়োগ করছে না। সরকার চাইছে যে শিল্পপতিরা বিনিয়োগ করুক। তাই সরকার মাস কয়েক আগে শিল্পপতি তথা কর্পোরেট ক্ষেত্রে ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা কর ছাড় দিয়েছে। কিন্তু ধনীদের কর ছাড় দিলেই যে তারা বিনিয়োগ করবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং অর্থনীতির তত্ত্ব বলে যে— কর ছাড় দিলে বিনিয়োগ বাড়ে না, বাড়তি এক টাকা পেলে ধনীরা তা সঞ্চয় করে, খরচ করে না, ফলে চাহিদাও বাড়ে না। সরকার তাই কোষাগারে বাড়তি বোঝা বাড়িয়ে শিল্পপতিদের ব্যাপক কর ছাড় দেওয়ার পরেও দেশের কমতে থাকা বৃদ্ধির হার বাড়েনি।
আরও পড়ুন: কাজ থেকে ক্রয়ক্ষমতা, ব্যাঙ্ক থেকে বৃদ্ধি, সর্বত্রই গভীর সঙ্কটের ছবি
অন্য দিকে, রফতানি বাড়লে চাহিদা বাড়বে। কিন্তু বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় মন্দাবস্থার দরুন সেই পথেও কোনও আশার আলো নেই। তা হলে চাহিদা বাড়ানোর একমাত্র উপায় সরকারি খরচ বাড়িয়ে, বিশেষ করে গরিব মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা, যাতে তারা খরচ করতে পারে, এবং অর্থব্যবস্থায় চাহিদা বাড়ে। ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ বাড়ানো, কৃষকদের ভাতা বাড়ানো, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বাড়তি খরচ ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করলে কমতে থাকা বৃদ্ধির হারের সমস্যার কিছুটা নিরসন করা সম্ভব। অন্য দিকে, সরকারি খরচের মাধ্যমে দেশের পরিকাঠামোর উন্নয়নও হবে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, সরকারের কাছে এই বাড়তি খরচ করার টাকা আসবে কোথা থেকে? এর দুটো উত্তর হয়, যা আমরা ক্রমান্বয়ে আলোচনা করব। প্রথম, সরকার যে কর এবং রাজস্ব আদায় করে তা বাড়িয়ে এই বাড়তি খরচ করা যেতে পারে। যদি এই বাড়তি কর ধনীদের থেকে আদায় করে খরচ করা হয়, তবে সার্বিক ভাবে দেশে চাহিদা বাড়বে। কিন্তু বাড়তি কর আদায় করা দূরস্থান, সরকার ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে কর আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা গত বাজেটে স্থির করেছিল, তার থেকে অনেক কম টাকা আদায় করতে পারবে। এর প্রধান কারণ আবার সেই আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া।
আমরা আগে যে আর্থিক বৃদ্ধির হারের হিসেব দিয়েছি তা ২০১১-১২ অর্থবর্ষের মূল্যে গণনা করা হয়েছে। কিন্তু কর আদায় হয় বর্তমান মূল্যে। প্রত্যেক বাজেটে সরকার বর্তমান মূল্যে জিডিপি-র পরিমাণ কত হবে তার একটা অনুমান করে, যার ভিত্তিতে কর সংগ্রহের হিসেব পেশ করা হয়। গত ২০১৯-২০ সালের বাজেট পেশ করার সময় নির্মলা সীতারামন অনুমান করেছিলেন যে— বর্তমান মূল্যে জিডিপি-র বৃদ্ধির হার হবে ১২ শতাংশ। কিন্তু পরিসংখ্যান দফতরের গণনা বলছে যে, এই বৃদ্ধির হার হবে মাত্র ৭.৫ শতাংশ, যা আবার ১৯৭৫-৭৬ সালের পরে সর্বনিম্ন। জিডিপি বৃদ্ধির অনুমানের তুলনায় প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধির হার যদি ৪.৫ শতাংশ বিন্দু (বেসিস পয়েন্ট) কম হয় তবে স্বাভাবিক ভাবেই কর আদায় করার যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল তা পূরণ করা যাবে না।
রয়টার্সের একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে প্রথমবার বৃদ্ধির হার ঋণাত্বক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে। ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ অবধি সরকার মাত্র ৭.৩ লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩.৫ লক্ষ কোটি টাকা। মার্চের ৩১ তারিখের মধ্যে বাকি ৬ লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করা যাবে বলে মনে হয় না। রয়টার্স জানাচ্ছে যে— শুধুমাত্র যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যাবে না তা নয়, ২০১৮-১৯ সালে মোট যত টাকা প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ করা হয়েছিল ২০১৯-২০ সালে তার থেকে কম টাকা আদায় করা যাবে। অন্য দিকে, জিএসটি কর সংগ্রহে ঘাটতি থাকবে। তাই ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে সরকার বাড়তি কর আদায় করা দূরস্থান, বরং আগের বারের বাজেটে ঘোষিত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারবে না।
আরও পড়়ুন: আয়কর কমার জল্পনা, লাভ নিয়ে প্রশ্ন
এ হেন অবস্থায় সরকার বাড়তি খরচ করতে পারবে যদি তারা অন্য উপায় রাজস্ব সংগ্রহ করে। যেমন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিল থেকে টাকা নেওয়া বা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বেচে দেওয়া। প্রথমটি সরকার ইতিমধ্যেই করেছে। কিন্তু বারবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তহবিলে হাত দিলে দেশের মুদ্রাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। আবার লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচে সরকারি খরচ চালানো বাড়ির গয়না বেচে সংসার চালানোর সামিল। সরকার যদিও বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই মন্দাবস্থা চলাকালীন সেই সংস্থাগুলির জন্য ন্যায্য মূল্য পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে।
তা হলে সরকার কী করতে পারে? সরকার বাজেট ঘাটতি, অর্থাৎ সরকারি খরচ ও আয়ের মধ্যের ব্যবধান বাড়িয়ে সরকারি খরচ বাড়াতে পারে। কিন্তু বাজেট ঘাটতি বাড়ালেই মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি রে-রে করে ওঠে, দেশ বুঝি রসাতলে গেল। আসলে তার কোনও যৌক্তিকতা নেই। রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদদের যুক্তি হল— বাজেট ঘাটতি বাড়ালে নাকি বেসরকারি বিনিয়োগ মার খাবে এবং দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। দুটি যুক্তিই অসার। বাজেট ঘাটতি বাড়ানো মানে সরকার বাজার থেকে ১০০ টাকা ধার নেবে এবং তা অর্থব্যবস্থায় খরচ করবে। অর্থব্যবস্থায় সেই খরচ বিনিয়োগের চেহারা নেবে, ফলে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছবে, যে টাকা তারা বাজারে খরচ করে মোট চাহিদা বাড়াবে। সুতরাং দেশের অভ্যন্তরীণ আয় এবং সঞ্চয় উভয়ই বাড়বে। সেই বাড়তি সঞ্চয় থেকে বেসরকারি পুঁজিও বিনিয়োগ করতে পারবে, অতএব তারা বাজার থেকে সরে যাবে না। বিশেষ করে যদি অর্থব্যবস্থায় বেকারত্ব থাকে, যা ভারতে বিপুল ভাবে রয়েছে, তবে বাজেট ঘাটতি বাড়ালে কোনও সমস্যা হবে না। বরং, বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে বেকারত্বের সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। অর্থব্যবস্থা একবার সঙ্কটের কবল থেকে বেরিয়ে এলে বাজেট ঘাটতি কমিয়েও আনা যেতে পারে।
কিন্তু সরকার এই পথে হাঁটবে বলে মনে হয় না। কারণ মিডিয়া, আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি এবং রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদেরা যেই ভ্রান্ত তত্ত্ব এত দিন ধরে প্রচার করে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকার সেই মতেরই অনুগামী। কংগ্রেস সরকারের আমলে আইন করে বাজেট ঘাটতির ঊর্ধ্বসীমা জিডিপি-র ৩ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ধরা হয়েছিল যে— বাজেট ঘাটতি হবে জিডিপি-র ৩.৩ শতাংশ। কিন্তু কর সংগ্রহ কম হবে। এমতাবস্থায় বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাবে যদি সরকার খরচ না কমায়। অন্য দিকে, খরচ কমালে অর্থব্যবস্থার সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে। তাই সরকার কী করে, তা দেখার জন্য আমাদের বাজেট অবধি অপেক্ষা করতেই হবে।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন যে— সরকার হয়ত বাজেট ঘাটতি নিয়ে খুব কড়াকড়ি করবে না। যদি করে, তা হলে এই সংকট থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। মোদী সরকারের আর্থিক নীতি সমূহের পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে তারা খুব বেশি অর্থনৈতিক যুক্তি মেনে নীতি প্রণয়ন করেনি। নোট বাতিল তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ। অতএব, নির্মলা সীতারামন কী করবেন তা রাম জানেন। কিন্তু এই সঙ্কটের আবহে সরকারের কাছে খুব বেশি বিকল্প পথ নেই। অবশ্য এই সঙ্কটের গভীরতা সরকার এখনও স্বীকার করেনি। অতএব বাজেটে যে তারা সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে খুব উদগ্রীব হবেন তা মনে হয় না।
(লেখক অর্থনীতির শিক্ষক)
গ্রাফিক: সৌভিক দেবনাথ