ফাইল চিত্র
ডোনাল্ড ট্রাম্প চাহিয়াছিলেন, প্রতিবাদীদের মোকাবিলা করিতে রাজধানী শহরে দশ হাজার সেনা প্রেরণ করা হউক। সেনাকর্তারা কঠোর বিরোধিতা করিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাহিয়াছিলেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সেনাশক্তিকে কাজে লাগাইতে দুই দশকের পুরাতন বিদ্রোহ আইন প্রয়োগ করা হউক। বর্তমান ও প্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচিব এক সুরে বিরোধিতা করিলেন, একাধিক প্রাক্তন সেনাকর্তার সমর্থনও পাইলেন। হোয়াইট হাউস ও পেন্টাগনের এই দ্বন্দ্বে সেনার অবস্থানটি স্বাভাবিক ও যুক্তিপূর্ণ, এবং প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপ অত্যন্ত দুর্ভাগ্যময়, বিপজ্জনক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা কেবল অনুচিত নহে, অন্যায়। নাগরিক আন্দোলন ঠেকাইতে সেনাবাহিনী নামাইয়া দিবার ভাবনাটি প্রশাসনিক ভাবেই বিপজ্জনক। আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলন কোথাও কোথাও হিংসাত্মক চেহারা লইলেও তাহার জন্য এমন পদক্ষেপের কথা ভাবিবার সময় আসে নাই, সেনাকর্তারা এবং বিরোধী নেতারা বলিতেছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অদম্য। তিনি ইতিমধ্যেই প্রতিবাদীদের ‘জঙ্গি’ বলিয়াছেন, আন্দোলনের প্রতি ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি লইয়াছেন, সামরিক প্রতিফলের হুমকি দিয়াছেন। স্বৈরাচারী শাসকের শক্তি প্রদর্শনের অভিলাষটি প্রকট হইতেছে। গণতন্ত্রে ক্ষমতা হাসিল না হইলে সহায়তা করিবে সেনাতন্ত্র— ইহাই স্বৈরশাসকের শাসনপন্থা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বহু প্রাক্তন সেনা প্রেসিডেন্ট পদ অলঙ্কৃত করিয়াছেন। কিন্তু স্মরণাতীত কালে প্রশাসন ও বাহিনীকে গুলাইয়া দিবার চেষ্টা কিংবা সেনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের এহেন উদাহরণ নাই। প্রতিষ্ঠানগুলি ন্যায্য স্বাধীনতা উপভোগ করিবার ফলেই মার্কিন গণতন্ত্রের ভিত পোক্ত হইয়াছে। ট্রাম্প দৃশ্যতই অপরিণামদর্শী, ভিন্ন পথের শরিক। রুশ সমাজে ভ্লাদিমির পুতিনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ তাঁহার পছন্দের, চিনের তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের গণহত্যাকে তিনি ‘বলশালীর ক্ষমতা’ বলিয়া মনে করেন, ফিলিপিন্সে জনতার উপর গুলি চালাইবার সরকারি নির্দেশকে সমর্থনযোগ্য ভাবেন। এই সকল দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সেনাবাহিনী অপরিহার্য। দেখা যাইতেছে, আয়তনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের বর্তমান শীর্ষনেতাও আজ তাহাদের অনুকরণে গণতান্ত্রিক শর্তাবলি লঙ্ঘন করিতে পিছপা নহেন।
গণতন্ত্রের পক্ষে এই লক্ষণ বিপজ্জনক বলিলে কম বলা হয়। গণতন্ত্র আত্মঘাতের পথে যাইতে চাহিলেই এমন পরিস্থিতির জন্ম হয়। এইখানেই গণতন্ত্র হইতে স্বৈরশাসনের সীমারেখাটি সর্বাধিক পিচ্ছিল। বিগত ছয় বৎসর ধরিয়া ভারতেও এই পিচ্ছিলতা বারংবার উঁকি মারিয়াছে। ভারতীয় গণতন্ত্র (যেন পাকিস্তান হইতে নিজেকে পৃথক রাখিবার তাড়নাতেই) সেনাবাহিনী হইতে দূরত্ব বজায় রাখিয়া চলিয়াছে, প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভারতীয় সেনাও এতগুলি দশক দলবিহীন এবং পেশাদার থাকিয়াছে। নির্বাচনী রাজনীতি, নীতি-নির্ধারণ বা প্রশাসন কোথাও সেনার কোনও ভূমিকা দেখা যায় নাই। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে কিন্তু একাধিক বার সেই পার্থক্যরেখা মুছিবার উপক্রম দেখা দিয়াছে। আমেরিকার বর্তমান ঘটনাবলি এই কারণেই ভারতীয় নাগরিকের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। আর গণতান্ত্রিক সভ্যতার পক্ষে, অশনি সঙ্কেত।