ধর্মীয় মেরুকরণের ধাক্কায় ভারতে ‘মানবধর্ম’-এর অস্তিত্ব বিপন্ন। রাজনৈতিক নেতা হইতে সাধারণ মানুষ— মানবধর্ম রক্ষা করিবার প্রতিশ্রুতিটি সচরাচর কাহারও আলোচনাতে উঠিয়া আসে না। কিন্তু অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন হইলেও তাহা একেবারে মুছিয়া যায় নাই কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের উদ্যোগে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের কিছু কলেজ তাহাদের অনলাইন ভর্তির ফর্মে অন্যান্য ধর্মের উপরে স্থান দিয়াছে মানবধর্মকে। অর্থাৎ, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ পরিচয়টিকে বাহিরে রাখিয়া শিক্ষার্থী নিজেকে ‘মানবধর্মের উপাসক’ ঘোষণা করিতে পারিবে। কিছু কলেজ অবশ্য চার বৎসর পূর্বেই ধর্মের কলামে ‘অ-বিশ্বাসী’ শব্দটিকে স্থান দিয়াছিল। এই বৎসর ইহার সঙ্গে মানবধর্ম এবং ধর্মনিরপেক্ষ-র মতো বিকল্পগুলি রাখিয়া উদ্যোগটিকে আরও বিস্তৃত করা হইল। প্রশ্ন উঠিয়াছে, প্রথাগত ধর্মগুলি হইতে মানবধর্মকে আলাদা করিয়া দেওয়ার যৌক্তিকতা লইয়া। তাহাতে কি প্রথাগত ধর্মীয়তার মধ্যেও যে মানবিকতা থাকিতে পারে, সেই সম্ভাবনাটি বিনষ্ট করিয়া দেওয়া হয় না? কূটতর্ক স্বাগত। কিন্তু মূল লক্ষ্যটি এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্পষ্ট। প্রথাগত ধর্মীয় পরিচয়ের বাহিরেও যে নিজেদের ভাবা যায়, তরুণ পড়ুয়ারা সেই অবস্থান স্পষ্ট করিবার এক সুন্দর সুযোগ পাইল।
কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে কি আদৌ শিক্ষার্থীর প্রথাগত ধর্মীয় পরিচিতির আবশ্যকতা আছে? আপাতদৃষ্টিতে, নাই। শিক্ষা সর্বজনীন। ধর্ম, জাতিভেদে তাহার কোনও তারতম্য হইবার নহে। তাহা সত্ত্বেও ভর্তির সময় ধর্মের উল্লেখের প্রয়োজন কেন? আসলে, রেওয়াজটি শুধু ভারতের নহে, বিভিন্ন দেশের। প্রয়োজনটি মূলত, ‘ডেমোগ্রাফিক প্রোফাইল’ সংক্রান্ত। ধর্ম এবং বংশ-উৎসের উল্লেখ হইতে জানা যায়, কোন প্রেক্ষাপট থেকে কত জন শিক্ষার্থী শিক্ষার সুযোগ পাইতেছে। সেই ক্ষেত্রে কোনও পশ্চাদগামিতা পরিলক্ষিত হইলে তাহাকে দ্রুত সংশোধন করাও সম্ভব হয়। ভারতের ক্ষেত্রেও ইহাই কারণ। কিন্তু, এই দেশের রাজনীতি সম্প্রতি ধর্ম ও জাত লইয়া যে ভাবে খেলিতেছে, তাহাতে সংখ্যালঘুর উন্নয়নের প্রয়োজনে ধর্মের উল্লেখ প্রয়োজন— কথাটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাইয়াছে। গুজরাতে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় শুধু মুসলিম পরীক্ষার্থীদের চিহ্নিতকরণের প্রয়াস হইয়াছে। অনলাইন ফর্ম পূরণের সময় সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের কাছে দুটি বিকল্প, মুসলিম বা অন্যান্য। ২০০২ সালের দাঙ্গাধ্বস্ত রাজ্য গুজরাত। আশ্চর্য নহে, সরকারি প্রয়াসে সংখ্যালঘুরা সিঁদুরে মেঘ দেখিতেছে। তাঁহাদের স্মরণে আছে, ২০০২ সালের পূর্বেও রাজ্য সরকারের পক্ষ হইতে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে নির্দেশ পৌঁছাইয়াছিল, মুসলিমদের ব্যবসাগুলিকে চিহ্নিত করিবার। সন্দেহ, সেই তথ্যই দাঙ্গাবাজরা ব্যবহার করিয়াছিল।
সুতরাং, অনাস্থা ও মেরুকরণের প্রেক্ষিতে একটি মধ্যপন্থা অবলম্বনের প্রয়োজন। গত কয়েক বৎসরে পড়ুয়াদের মধ্যে কিছু অন্য ভাবনা দেখা যাইতেছে। অনেকেই ধর্মীয় পরিচয়ের জায়গায়, নিজেকে ‘অ-বিশ্বাসী’ বলিয়া উল্লেখ করিতেছিল। কেরলে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার স্কুলপড়ুয়া ভর্তির ফর্ম পূরণের সময় নিজ ধর্ম এবং জাতিগত পরিচয়টি উল্লেখই করে নাই। নবীন প্রজন্মের একাংশ হয়তো ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে প্রথাগত পথে হাঁটিতে রাজি নহে। এই দুঃসময়ে এহেন সাহসের বড়ই প্রয়োজন।