কেউ একশোয় একশো পায় ইতিহাসে, জীবনে শুনেছেন?’ শিবুদার উদ্দেশে প্রশ্ন করল শিশির। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের রেজ়াল্ট বেরনোর পর থেকেই শিশির উত্তেজিত। শিবুদাকে পেয়েই প্রশ্ন করল তাই।
‘কেন পাওয়া যাবে না, সেইটে বল দিকি।’ একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে কান খোঁচানোর বিপজ্জনক চেষ্টা করতে করতে উত্তর দেন শিবুদা। ‘এই ক্লাসের ছেলের যতটুকু জানা উচিত বলে শিক্ষক মনে করেন, বোর্ড মনে করে, কেউ যদি ততটা লিখতে পারে, তাকে পুরো নম্বর দেওয়াই তো উচিত। আসল সমস্যা একটা ছেলে বা মেয়ের ইতিহাসে একশো পাওয়ায় নয়, সমস্যা অন্যত্র।’
শিবুদার উত্তরে একটু থতমত খেয়ে যায় শিশির। বলে, ‘মানে, আপনি মনে করেন না যে এখন নম্বরের একটা ইনফ্লেশন চলছে? অবশ্য, এখন আর এই নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই— নতুন শিক্ষানীতি তো পরীক্ষাগুলোকেই অর্থহীন করে দিল।’
কফির কাপটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করলেন শিবুদা। ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বললেন, ‘টেনের পরীক্ষার গুরুত্ব থাকল কি না, সেটা আসল কথা নয়। কেন, পরে বলছি। কিন্তু দাঁড়া, আগে কফিটা গরম করে আনি। অন্য প্রশ্নটা ইন্টারেস্টিং।’
সপ্তাহে এক দিন অনলাইন আড্ডা এখন নিয়ম হয়ে গিয়েছে তপেশদের। দোকানের ঝাঁপ ফেলে গোপাল দেশে চলে গিয়েছে।
‘ইনফ্লেশনের কথা বলছিলি, তাই তো?’ কফির কাপ হাতে ফিরে আসেন শিবুদা। আয়েশ করে একটা চুমুক দিলেন। ‘দ্যাখ, আমি যে বার হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলাম, তখন খাসির মাংসের কেজি বোধ হয় চল্লিশ টাকা ছিল। কাল শুনলাম, হাজির দোকানে রেওয়াজি সাড়ে সাতশো টাকা করে যাচ্ছে। কিন্তু, দামের ইনফ্লেশনের কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই, নম্বরের আছে। আমাদের সময়েও একটা সাবজেক্টে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যেত একশো, এখনও তা-ই যায়। তুই ইনফ্লেশনের কথা কেন বলছিস, সেটা বুঝতে পারছি— চল্লিশ টাকার খাসির সঙ্গে সাড়ে সাতশো টাকার খাসির স্বাদে ফারাক নেই। অর্থাৎ, যে ছেলেটা একশোয় একশো পেয়েছে, তোর ইতিহাসজ্ঞান তার চেয়ে কম নয়, যদিও তুই পেয়েছিলি তিয়াত্তর!’
তপেশ আর সূর্য অট্টহাস্য করে। শিশিরও হাসে।
‘আসলে যেটা হচ্ছে, সেটার নাম কমপ্রেশন। যে হেতু নম্বর বাড়ার একটা লিমিট আছে, যেটাকে টপকানো যাবে না কোনও মতেই, এ দিকে নম্বর বাড়াতেও চাইছে বোর্ড— ফলে, ওপরের দিকে ঠাসাঠাসি বাড়ছে। আমাদের সময়ে স্টার পেলে পাড়ার লোক উজিয়ে দেখতে আসত, বুঝলি। তোরা যখন পরীক্ষা দিলি, তখন মাধ্যমিকে মুড়ি-মুড়কির মতো স্টার পাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। এখন মেয়ে পঁচানব্বই পার্সেন্টের নীচে পেলে বাপ-মা অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট বড়ি খাচ্ছে শুনছি। যত ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, তার ফিফটিন পার্সেন্ট নম্বর পাচ্ছে নব্বই পার্সেন্টের ওপরে— বুঝতে পারছিস অবস্থাটা?’ শিবুদা থামলেন।
‘হরে দরে তো সেই এক কথাই দাঁড়াল— আগে যারা সত্তর পেত, এখন তারাই নব্বই পাচ্ছে।’ শিশির এখনও শিবুদার কথা মানতে রাজি নয়।
‘কিন্তু, যারা আগে নব্বই পেত, তারা কত পাচ্ছে এখন?’ শিবুদা কিছু বলার আগেই কথার খেই ধরে নেয় সূর্য। ‘ইনফ্লেশনের ধর্ম মানলে তো তাদের নম্বর একশো ছাড়িয়ে বহু দূর চলে যাওয়ার কথা। যাচ্ছে?’
‘মোক্ষম ধরেছিস!’ শিবুদা প্রশংসা করেন সূর্যর। ‘একশো ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলেই নম্বরের কমপ্রেশন হচ্ছে ওপরের দিকে। এ বারের মাধ্যমিকের কথাই ধর— প্রথম দশে মোট ৮৪ জন। পনেরো বছর আগের রেজ়াল্ট খুঁজে দেখ, সংখ্যাটা কুড়ি ছাড়াত বলে মনে হয় না। আরও পনেরো বছর আগের রেজ়াল্ট দেখ— প্রথম দশে দশ জনের বেশি থাকাটা ঘোর ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। কেন, সেটা ভাব এ বার। যদি বলিস, এই রাজ্যে বছর বছর মেধাবী সংখ্যা বেড়েই চলেছে, সেটা বিশ্বাস করা মুশকিল— এক তো সার্বিক মেধা এই পরিমাণ বাড়ার মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি; তার চেয়েও বড় কথা, পরীক্ষার রেজ়াল্ট ছাড়া আর কোনও দিকে তাকালেই মেধার এই বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়বে না। কাজেই, এই ঘটনাটা ঘটছে, তার একমাত্র কারণ হল, ওপরের দিকে নম্বর দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। শুধু মাধ্যমিকে নয়, সব বোর্ডেই এক ঘটনা ঘটছে।’
দম নেওয়ার জন্য থামলেন শিবুদা। একটা সিগারেট ধরালেন, খুকখুক করে কাশলেন বার কয়েক। তার পর বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা বেশি নম্বর পাচ্ছে, তাতে আপত্তি করতাম না, যদি না এতে ওদের আখেরে ক্ষতি হত।’
‘ক্ষতি, মানে বলছেন, মাধ্যমিকে গাদাগুচ্ছের নম্বর পেয়ে মাথা ঘুরে যাবে?’ প্রশ্ন করে তপেশ।
‘বলছি না।।’ মাথা নাড়লেন শিবুদা। ‘আমি প্র্যাকটিকাল ক্ষতির কথা বলছি। নম্বর জিনিসটা কী, ভাব। বাপ-মা’রা যদিও ওটাকে প্রেস্টিজ ইস্যু বানিয়ে ফেলে, আসলে তো নম্বর একটা ইনফর্মেশন বই কিছু নয়। কোন ছাত্র তার স্তরের লেখাপড়াটা কতখানি ভাল ভাবে শিখেছে, একটা স্ট্যান্ডার্ড মেথডলজি ব্যবহার করে সেটা মেপে, তুলনা করা যায় এমন এক ভাবে সেই তথ্যটাকে প্রকাশ করা হয়— এটাই নম্বর। সেটা বাপ-মার জন্য নয়, পাড়াপড়শির জন্যও নয়— এই ছেলেমেয়েগুলো পরবর্তী ধাপে যেখানে পড়তে যাবে, এই তথ্যটা মূলত তাদের জন্য। নম্বরের কমপ্রেশনে এই তথ্যটা কমজোরি হয়ে যাচ্ছে। যদি ইনফ্লেশন হত, তা হলে এই সমস্যা থাকত না— সবার নম্বর সমান হারে বাড়লে তুলনা করতে সমস্যা হত না। কিন্তু, যে ছেলেটা কুড়ি বছর আগে হলে সত্তর পেত, সে যদি বিরানব্বই পায়, আর যে কুড়ি বছর আগে নব্বই পেত, সে যদি এখন একশোও পায়— রেশিয়োটা পাল্টে যাবেই। অর্থাৎ, নম্বরের ভিতরে তথ্যের পরিমাণ কমছে।’
‘কিন্তু, পরীক্ষার নম্বরকে এতটা গুরুত্বই বা দিচ্ছেন কেন? একটা ভাল ছেলে তো খারাপ পরীক্ষাও দিতে পারে।’ তপেশ পাল্টা প্রশ্ন করে।
‘একশো বার।’ এক কথায় মেনে নেন শিবুদা। ‘কিন্তু, সে কথাটা তো সব ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রেই সত্যি। আবার, তেমন পড়াশোনা না করেও কমন প্রশ্ন পেয়ে ফাটিয়ে দেওয়া যায়। যেখানে দশ লাখ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, সেখানে ল’ অব লার্জ নাম্বার্স-এর
কল্যাণেই এই খুচরো ওঠাপড়াগুলো ঢাকা পড়ে যাবে। আমি যে ক্ষতিটার কথা বলছি, সেটা কতখানি বড়, কী করে বুঝবি জানিস? এখন প্রায় সব ভাল কলেজেই নিজস্ব অ্যাডমিশন টেস্টের ব্যবস্থা আছে— কেউ আর উচ্চ মাধ্যমিকের রেজ়াল্টের উপর ভরসা করে ছাত্র নেয় না। ভরসা করে না, তার কারণ একটা নয়, তা অস্বীকার করব না— অনেক কলেজই মনে করে যে তাদের প্রতিষ্ঠানে কোনও বিশেষ বিষয় পড়ার যোগ্যতা বা ঝোঁক কোনও ছাত্রের আছে কি না, সেটা উচ্চ মাধ্যমিকের রেজ়াল্টে বোঝা যায় না। আলাদা করে পরীক্ষা করে দেখাই ভাল। তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু, এখন যে প্রতি বছর নতুন নতুন প্রতিষ্ঠআন নিজস্ব অ্যাডমিশন টেস্টের দিকে ঝুঁকছে, তার একটা কারণ এটাও যে নম্বরের মধ্যে ছাত্র সম্বন্ধে তথ্যের পরিমাণ বিপজ্জনক রকম কম, ওতে আর ভরসা করা যায় না।
‘তাতে ক্ষতি কার? বোর্ডের কাঁচকলা ক্ষতি। স্কুলেরও। ক্ষতি ছেলেমেয়েগুলোর। একটা গোটা পরীক্ষা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য। উচ্চ মাধ্যমিকে যেমন রেজ়াল্টই হোক, পরের ধাপে যেতে গেলে আলাদা পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া গতি নেই। এটা কতখানি ইনএফিশিয়েন্ট ব্যবস্থা, ভাবতে পারিস?’
তপেশরা স্তম্ভিত। সত্যিই এই দিক থেকে ঘটনাটাকে দেখেনি ওরা কেউ।
‘এর থেকে বেরনোর একটা রাস্তা না তৈরি করতে পারলেই নয়।’ আবার একটা সিগারেট ধরালেন শিবুদা। ‘নতুন শিক্ষানীতি দেখে এই যে সবাই বলছে টেন-এর পরীক্ষাটা গুরুত্বহীন হয়ে গেল, সেটা আসলে কথাই নয়। প্রশ্নটা টেন-টুয়েলভের নয়, প্রশ্নটা স্কুল-শেষের পরীক্ষা নিয়ে। সেটায় নম্বরের বন্যা বইয়ে নম্বর জিনিসটাকে তথ্যহীন করে দেওয়ার প্রবণতা কি এই শিক্ষানীতিতে আটকাবে? না। সেটা থেকে বেরনোর একটা উপায় হতে পারে নম্বরের বদলে পার্সেন্টাইল জানানো— মানে, কার নম্বর কত শতাংশ ছাত্রের চেয়ে বেশি, সেই তথ্যটা দেওয়া। এগ্রিগেটেও, প্রতি সাবজেক্টেও। তাতেও যে পুরো সমস্যা মিটবে, তা নয়— কিন্তু, যেখানে পরীক্ষায় কে কত নম্বর পেল, সেটা আর বিচার্যই হবে না, কে কত জনের চেয়ে এগিয়ে থাকল, শুধু সেটা বিচার্য হবে, সেখানে ঢালাও নম্বর দেওয়ার প্রবণতাটা কমতেও পারে। পরীক্ষকদের উপর নম্বর দেওয়ার চাপ কমবে, তাতে পরীক্ষার আসল উদ্দেশ্যটা বাঁচবে।
‘দ্যাখ, যে ছেলেমেয়েগুলো এত ভাল নম্বর পাচ্ছে, তাদের কৃতিত্বকে কোনও ভাবে ছোট করছি না— এটাও বলছি না যে কোনও ভাবেই একশোয় একশো দেওয়া যাবে না— আমি শুধু একটু বলছি, নম্বর জিনিসটার আসলে আলাদা কোনও গুরুত্ব নেই। যে তথ্যটা তার বহন করার কথা, সেটুকু করতে দিলেই যথেষ্ট হয়। সেই পথ যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে একশোয় একশো পেয়েও কী লাভ?’