Tourism

চিলাপাতার জঙ্গলে বৃষ্টি দেখার অপেক্ষায়

মনে পড়ে সেই কিরণ  দাজু, অনিতা কাকিদের কথা। জানি না কেমন আছেন ওঁরা। জানি না কবে আবার দেখা হবে। সামনে সবুজে ঢাকা ভুটান পাহাড় আর রিসর্টের একপাশে বয়ে চলেছে নদী।

Advertisement

নবনীতা গুহ

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২০ ০৩:০২
Share:

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লাল রঙের ঘর। সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে আসতেই মনটা জুড়িয়ে গেল। কানে এল জলের প্রচণ্ড আওয়াজ। অবাক হয়ে তাকাতেই রিসর্ট মালিক সন্তোষদা জানালেন, পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে জলঢাকা। একছুটে চলে গিয়েছিলাম দেখতে। আহা, কী রূপ তার, কী স্রোত! বছর সাতেক আগে ঝালংয়ে এমনই ছিল একটা বিকেল।

Advertisement

সামনে সবুজে ঢাকা ভুটান পাহাড় আর রিসর্টের একপাশে বয়ে চলেছে নদী। না, কোনও পথ, কোনও সিঁড়ি ছিল না। তবু নেমে পড়েছিলাম নীচে, নদীর কাছে। সেই প্রথম এত কাছ থেকে পরিচয় জলঢাকার সঙ্গে। তখন সন্ধে নেমেছে, চাঁদের হাসিও বাঁধ ভেঙেছে। আর নদীকূলে আমি একলা। চোখ বন্ধ করতে মনে হয়েছিল কত আনন্দ ওই নদীর চলায়। আমার মতো সে-ও যেন হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল!

অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, ডাক পড়ল উপরে উঠে আসার। হঠাৎ করে আসা, বলাও হয়নি যে সারাদিন তেমন খাওয়া হয়নি। কিন্তু তাতে কী! সন্তোষদার নেপালি স্ত্রীর হাতের গরমাগরম রান্না আর ওঁদের গল্পে আমি ততক্ষণে তৃপ্ত। দু’জন মিলেই কাজ সামলান ওঁরা। বাগানও করেন। কিন্তু আক্ষেপ একটাই, অনেক দূর থেকে বাজার নিয়ে আসতে হয়। সে বড় কঠিন!

Advertisement

বয়ে যেতে ইচ্ছে হত করোনেশন ব্রিজ থেকে সবুজের দিকে তাকিয়ে। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমি তখন কিশোরী, বুকের মধ্যে তিস্তা। তন্দ্রা ভেঙে এগিয়ে আসতেই মোমো আর গরম গরম স্যুপের গন্ধ। খুপরি সব খাবারের দোকানের সে স্বাদ কী ভোলা যায়! বেশ আদর করে খাওয়াতেন ওঁরা, সঙ্গে চলতো গল্প। নিমেষে কতই না আপন হয়ে যেতেন!

দু’দিকে সবুজের সারি পেরিয়ে পথ মিলিয়ে যায় নীলচে-সবুজ পাহাড়ের ভিতরে। তেমনিই পথে এসে পৌঁছেছিলাম সুনতালেখোলার রাস্তায়। ঝোলানো ব্রিজের দু’পাশের দড়ি ধরে এগিয়ে চলেছি। ওপাশের কাঁচা রাস্তাটা বেঁকে চলে গিয়েছে। ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম। শুধুই জলের আওয়াজ। আর নিস্তব্ধতার। এ সব রাস্তায় দেখা হয়ে যেত নাম না জানা কত ফুলের সঙ্গে।

এমনই সবুজ পথে কখনও চলে গিয়েছি লাটাগুড়ি বা চাপড়ামারিতে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় দেখা দিয়েছে ময়ূর। আরও গভীরে আড়াল থেকে দেখেছি ধুলো উড়িয়ে বুনো হাতিদের চলে যাওয়া। এমন রাজকীয় চলন, ভয় পেতেও যেন ভাল লাগে। দেখেছি বাইসন বা হরিণের পালের এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তায় চলে যাওয়া। চোখে পড়েছে কতই না পাখি। তার চেয়ে বেশি কানে এসেছে তাদের আওয়াজ। আর রিসর্টে ফিরলে, আবার সেই অপূর্ব নিস্তব্ধতা।

সেই রিসর্টেও কখনও যত্নের অভাব হয়নি। বড্ড খিদে পেয়েছে শুনে আকাশদাদা নিয়ে হাজির দেশি মুরগির ঝোল আর ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত। মনে পড়ে রাস্তার ধারে সেই সমস্ত চায়ের দোকান, যেখানে জুড়ে যেত আড্ডা। শোনা যেত, এই তো সেদিন কোথায় বেরিয়ে এসেছিল হাতি, গাছে উঠে পড়েছিল চিতাবাঘ। আশপাশের বাঁশ আর বেতের কী নেই সেখানে! আর কার কী চাই, তা-ও বেশ ধরে ফেলতেন ওরা। সঙ্গে চা খেয়ে যাওয়ার আবদার। গল্পে গল্পে সন্ধ্যা নেমে যেত। দু’দিনের অতিথি তো, আবার কবে দেখা হয় কে জানে!

মনে পড়ে, টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখতে গিয়েও করে ফেলেছিলাম দেরি। রক্ষাকর্তা কিরণ দাজু। ঠিক সময়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সাদা পাহাড়চূড়ায় লাল সূর্য দেখে যখন ফিরছি, প্রশ্ন করলেন, ‘‘বহুত ভুখ লাগা না, দিদি?’’ খিদেয় তখন সত্যি পেট চুঁইচুঁই। নিয়ে গিয়েছিলেন খুব সাধারণ একটি দোকানে। সে স্বাদ এখনও ভুলিনি। পাথরের গলার হার কিনতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল অনিতা কাকীর সঙ্গে। তার পরে অবশ্য গল্প এগোলো আরও। কাকিরই এক আত্মীয়ের বাড়ি সিকিমের জুলুকে। এক আলাপেই চলে গিয়েছিলাম সেখানে, হোম-স্টে। কী যে আদর পেয়ছিলাম, ভোলার নয়।

ভুলিনি ওঁদের, ভুলিনি সেই সবুজের পরশও। শুধু এই কংক্রিটের জঙ্গলে বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম! তাই নীল আকাশ কবে ধূসর হয়েছে, কবে যে জঙ্গলের গভীরে আলো ঢুকে পড়েছে, বুঝতেই পারিনি। খোঁজ নেওয়া হয়নি সেই সদা হাস্যময় সন্তোষদা, আকাশদাদার। আর এখন, হঠাৎ একটা কঠিন সময়ে থেমে গিয়ে সব কেমন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। শুধুই ভাবছি, আবার কবে ফিরে পাব সেই সবুজ, সেই নদী, সেই পাহাড়। আমরা ঘরবন্দি বটে, কিন্তু মন তো পথে পথে বাহির হয়ে আপন-হারা। সে তো মানে না লকডাউন!

শুধুই পিছনে তাকাচ্ছি। এই বন্দিদশার মুক্তি কবে, তার তো হিসেব নেই। তাই তো কত না টিকিট বাতিল হল, কত না মন ভাঙল। পুজোর ছুটি বা বছর শেষেও যাঁদের যা পরিকল্পনা ছিল, সবই এখন বলতে গেলে বাতিলের খাতায়।

ট্যুরিজ়ম সংস্থাগুলির মাথায় হাত। ভাল নেই ছোট-বড় হোটেল ব্যবসায়ী, রেস্তরাঁর কর্মী, গাড়ি ব্যবসায়ীরাও। কাজ নেই কারও। কবে দেখা মিলবে পর্যটকদের! অনিশ্চিত হোম-স্টে। রাস্তার ধারের সেই দোকানগুলি, দেশ-বিদেশের পর্যটকদের অপেক্ষায় বসে থাকেন যাঁরা, ধুঁকছেন তাঁরাও। মনে পড়ে সেই কিরণ দাজু, অনিতা কাকিদের কথা। জানি না এখন কীরকম আছেন ওঁরা। এ-ও জানি না আবার কবে দেখা হবে, আর এক কাপ গরম চা বা একবাটি গরম স্যুপের সঙ্গে জমাটি আড্ডা!

শহুরে ফ্ল্যাটবাড়িতে বসে নীল আকাশ আর পাখির ডাক, মন্দ লাগছে না। কিন্তু এ শহরের তো প্রাণ নেই। বন্দিদশা কাটলে সে তো হয়ে যাবে সেই যন্ত্রই। তাই শুধু অপেক্ষা। আবার কবে চিলাপাতার জঙ্গলে যাব, দেখব ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। চোখ জুড়িয়ে যাবে। মনে মনে বলব- বুঝি এল ওরে প্রাণ!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement