পরিবেশ সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ‘Climate action’ স্লোগান নিয়ে এই বছর পালিত হচ্ছে এই দিবস। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। সমসাময়িক ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো ঘটনা নাড়া দিয়েছিল আমেরিকার জনগণকে। দেশটির বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছিল যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন। সঙ্গে অন্য সামাজিক বিষয়েও সচেতনতা তৈরি হচ্ছিল মানুষের মধ্যে। তবে পরিবেশ বিষয়ে তখনও খুব একটা আলোচনা ছিল না।
১৯৬২ সালে এক জন মানুষের লেখা বদলে দেয় পুরো প্রেক্ষাপট। তিনি হলেন— সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী র্যাচেল লুইজ কার্সন। তাঁর লেখা ‘Silent Spring’ বইয়ে তিনি পরিবেশের উপরে কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেন। আমেরিকার জনগণের মধ্যে তুমুল গণ-আলোড়ন সৃষ্টি করে বইটি। জন্ম নেয় আধুনিক পরিবেশ আন্দোলনের। বইটি প্রকাশের পরে আমেরিকায় বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক যেমন, ডিডিটি ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এ ভাবেই শুরু হয় গণজাগরণের পটভূমি। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে, পরিবেশ বাঁচানোর প্রয়োজনীয়তা।
সেই ধারণা থেকে কয়েক বছর পর আসে একটি নির্দিষ্ট দিনকে পরিবেশের জন্য রাখার পরিকল্পনা। রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে দূরে সরে পরিবেশ আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসন। ১৯৬৯ সালে তিনিই প্রথম বারের মতো ধরিত্রী দিবস উদ্যাপনের প্রস্তাব দেন। কয়েক জন শিক্ষার্থীর সহায়তায় ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল আয়োজন করা হয় প্রথম ধরিত্রী দিবস। প্রায় ২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ দিনটি উদ্যাপন করেছিলেন।
এই বছর এই ধরিত্রী দিবসের পঞ্চাশতম বার্ষিকী উদ্যাপন। ‘ক্লাইমেট অ্যাকশান’ স্লোগান দিয়ে জনসাধারণকে বার্তা দেওয়া হবে যে, পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পরিবেশ ও জলবায়ুর গুরুত্ব কতখানি। পরিবেশ রক্ষার কথা মাথায় রেখে ১৯৭০ সালের পর থেকে বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিভিন্ন আইন। ‘Environmental Protection Agency’, বায়ুদূষণ প্রতিরোধে ‘Clean Air Act’, জল সংরক্ষণ করার জন্য ‘Clean Water Act’, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের জন্য গঠন করা হয় ‘Resource Conservation and Recovery Act’। এমন বহু আইন গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রনয়ণ করার পরেও আজ এই পৃথিবী সঙ্কটের মুখে।
আমরা সচেতন ভাবেই এই পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। মনুষ্য-কারণে সৃষ্ট গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রভাবে দিন দিন ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ওজোন স্তর, তৈরি করা হচ্ছে ওজোন ছিদ্র (ozone hole)। ওজোন ধ্বংসকারী রাসায়নিক ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন, হ্যালন, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, মিথাইল ক্লোরোফর্ম, মিথাইল ব্রোমাইড, হাইড্রোব্রোমোফ্লোরোকার্বন, হাইড্রোফ্লোরোকার্বন ইত্যাদির উৎপাদন ও ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বাড়ছে। কিছু প্রাকৃতিক নিয়মে ওজোন স্তর নষ্ট হচ্ছে। যদিও সেগুলি প্রাকৃতিক ভাবে তৈরিও হয়ে যায়। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্টি ধ্বংসগুলি অপরিবর্তনশীল ভাবে থেকেই যায়। এর ফলে যেমন মানুষের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি প্রভাবে কর্নিয়া নষ্ট, চোখে ছানি পড়া, ত্বকের ক্যানসার (ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা), ফুসফুসের ক্যানসার এবং অন্য রোগের সূচনা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, ৫% ওজোন স্তরের ক্ষয়ের জন্য সারা বিশ্বে পাঁচ লক্ষ লোক ত্বকের ক্যানসারে ভুগবেন।
একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১% অতিবেগুনি রশ্মি বৃদ্ধির ফলে সাদা চামড়ার লোকদের মধ্যে নন মেলোনোমা ত্বকের ক্যানসার বৃদ্ধি পাবে ৪ গুণ। জিনের স্থায়ী পরিবর্তন ঘটতে পারে। কমিয়ে দেয় প্রজনন ক্ষমতা। এর ফলে প্রাণিজগতের অনেক প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। শুধু মনুষ্য প্রাজাতির উপরেই নয়, এটি সমান ভাবে উদ্ভিদ ও উভচর প্রাণীর উপরেও ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। উদ্ভিদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, ক্লোরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এমনকি, অকালমৃত্যু ও প্রজাতির বিলুপ্তিও ঘটতে পারে। সমুদ্রের ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন, শৈবাল চিরতরে নষ্ট হতে পারে। ফলে, দেখা দেবে মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্যাভাব।
উন্নয়নের হাত ধরে নগরে নগরে গড়ে উঠেছে শিল্প, কলকারখানা। দিনের পর দিন দিন বর্জ্যপদার্থ জলে মিশছে। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণও বাড়ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে। নাসার সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, উনিশ শতকে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ১.৬২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি পেয়েছে। মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ গলছে দিনের পর দিন। গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টাকর্টিকাতে প্রতি বছর যথাক্রমে ২৮৬ ও ১২৭ বিলিয়ন টন বছর গলে যাচ্ছে। ফলে, সমুদ্রে জলের পরিমাণও বাড়ছে। এক দিকে সমুদ্রের বরফ গলছে, অন্য দিকে অতিরিক্ত বরফ গলা জল জমা হচ্ছে। এই দুয়ের ফলে শেষ এক শতকে সমুদ্রের গড় উচ্চতা বেড়েছে ৮ ইঞ্চি। এর ফলে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কাও বাড়ছে। এক সমীক্ষা বলছে, ২১০০ সালের মধ্যে উপকূলীয় এলাকাগুলি সম্পূর্ণ জলের তলায় চলে যেতে পারে। কারণ, সমুদ্রের অতিরিক্ত জল ধারণ করার ক্ষমতা নেই। নদীগুলির নাব্যতাও দিনের পর দিন মড়া হচ্ছে। বনজঙ্গল ধ্বংসের ফলে মাটির ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অধিক জনঘনত্বের ফলে কোথাও কোথাও নদী ভরিয়ে বসতি গড়ে উঠছে। সঙ্কটে দেখা দিচ্ছে জলজ প্রাণীদের বাসস্থানের।
অন্য দিকে, শিল্পায়নের ফলে যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হচ্ছে, তেমনই প্রাণীদের শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও বাতাসে মিশছে। এই গ্যাস শুধুমাত্র গাছ শোষণ করে না। অনেকাংশে শোষণ করে সমুদ্রের জল। উৎপাদন বাড়ায় সমুদ্রের শোষণ ক্ষমতা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে জলের অম্লত্বও বাড়ছে। তথ্য অনুযায়ী, বছরে প্রায় ২ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষিত হচ্ছে সমুদ্রের জলে। এর ফলে জলজ প্রাণীদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে সমুদ্র। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী। নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র।
আর সব খারাপের প্রভাব যে পরিবেশের উপর পড়বে, সর্বোপরি, মানুষই এর খারাপ ফল ভোগ করবে, সেই বোধ এখনও অনেকের মধ্যে জন্মায়নি। একটা মশা, একটা মাছিও যে বাস্তুতন্ত্রের অংশ, সেই ধারণা কত জনের মধ্যে আছে? প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের কথা না হয় বাদই দিলাম, বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে সরকারি কল থেকে অনর্গল জল পড়ে যাচ্ছে দেখেও কত জন সে দিকে খেয়াল করি? যাঁরা দশ মিনিটের হাঁটা দূরত্বের পথ যেতে পেট্রল, ডিজেল পুড়িয়ে গাড়িতে যান, তাঁরা তো ভাববেনই— যত দিন প্রাণ আছে, তত দিন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই মূল বিষয়।
তবে জেনে রাখুন একটা কথাও। এই পৃথিবীতে মনুষ্য সমাজকে শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। সংরক্ষণের দায়িত্বও নিতে হবে তাদের। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যদি সুস্থ পৃথিবী উপহার দিতে না পারেন, সে দায় কিন্তু আপনার ঘাড়েও বর্তাবে। পরিবেশের সঙ্গে, পৃথিবীর সঙ্গে খারাপ করতে করতে নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ছেন একটু একটু করে। সাধু সাবধান।
লেখক চিকিৎসক