কন্যাভ্রূণ হত্যায় ভারতের স্থানটি বিশ্বে অগ্রগণ্য। সেই ‘শীর্ষ’ হইতে নিকট ভবিষ্যতে দেশ সরিয়া আসিবে, তাহার সম্ভাবনা নাই। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, কন্যাভ্রূণ হত্যার ধারা অব্যাহত থাকিলে ২০১৭-২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি বৎসর মাতৃগর্ভেই নাশ হইবে ৪,৬৯,০০০ কন্যা। ২০২৬-২০৩০ সালের মধ্যে সেই সংখ্যা পৌঁছাইবে প্রতি বৎসর ৫,১৯,০০০-এ। অর্থাৎ , ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ হইতে জন্মের পূর্বেই মুছিয়া যাইবে প্রায় ৬৮ লক্ষ কন্যাসন্তান। সমীক্ষা আরও জানাইতেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই বিষয়ে দেশে প্রথম স্থানটি দখল করিবে উত্তরপ্রদেশ। ভয়ঙ্কর চিত্র, সন্দেহ নাই। অথচ, দেশে কন্যাভ্রূণ হত্যা রোধে একটি সুস্পষ্ট আইন রহিয়াছে। ১৯৯৪ সালের সেই আইন অনুসারে, ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ এবং কন্যাভ্রূণ হত্যা উভয়ই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তৎসত্ত্বেও এই মারাত্মক অপরাধ বন্ধ করিতে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির যে কঠোর পদক্ষেপ করিবার প্রয়োজন ছিল, তাহা হয় নাই। ফলত, আইনের আড়ালেই অবাধে চলিতেছে লিঙ্গ নির্ণয় এবং কন্যাভ্রূণ হত্যা। দুই বৎসর পূর্বে নীতি আয়োগের একটি রিপোর্ট হইতে স্পষ্ট হইয়াছিল, ২০১২ সাল হইতে ২০১৫ সালের মধ্যে ২১টি রাজ্যের ১৭টিতেই শিশুকন্যার জন্মের অনুপাতে উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটিয়াছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনের ধারা লইয়া অপরাধীরা বিশেষ ভাবিত নহে। আইন ভাঙিয়া কন্যাভ্রূণ হত্যার অপরাধে বিগত কয়েক বৎসরে বহু চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হইয়াছে ঠিকই, কিন্তু সাজাপ্রাপ্তদের সংখ্যাটি যৎসামান্য। সুতরাং, কখনও গোপনে বিভিন্ন ক্লিনিকে, কখনও বাড়ি আসিয়া আলট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির মাধ্যমে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ এবং গর্ভপাত করাইবার প্রক্রিয়াটি কেহ রুখিতে পারে নাই। কমাইতেও পারে নাই। ইহাতে শুধুমাত্র যে কন্যাসন্তানরাই হারাইয়া যাইতেছে, তাহা নহে। অদক্ষ হাতে গর্ভপাত করাইবার কারণে প্রসূতির প্রাণসংশয়ের ঘটনাও ঘটিতেছে।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ১৯৯০ সালে সর্বপ্রথম ‘মিসিং উইমেন’-এর উল্লেখ করিয়াছিলেন। ‘মিসিং উইমেন’, অর্থাৎ কোনও দেশে বা নির্দিষ্ট কোনও অঞ্চলে মেয়েদের সংখ্যা যাহা হওয়া উচিত, তাহা অপেক্ষা কম থাকা। ত্রিশ বৎসর অতিক্রান্ত। এখনও ভারতে কন্যাভ্রূণ হত্যা অব্যাহত। এই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যে আইনটি যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করা হইল না, তাহা নহে। কন্যাসন্তান না চাহিবার পিছনে সমাজের যে জরাগ্রস্ত মানসিকতা দায়ী, তাহাতেও উপযুক্ত সংস্কার হইল না। কন্যাভ্রূণ হত্যার সহিত নিবিড় ভাবে যুক্ত অপর একটি অপরাধ, পণপ্রথা। সেই বিষয়েও ভারতে কেহ আইন ভাঙিতে দ্বিধা করে না। প্রশাসক, পুলিশ এবং চিকিৎসক মহলে নারীবিদ্বেষ অব্যাহত বলিয়াই নাবালিকা বিবাহ, বধূ নির্যাতন, পণপ্রথা, কন্যাভ্রূণ হত্যা প্রভৃতি দণ্ডনীয় অপরাধ হইলেও কার্যত অসীম প্রশ্রয় পাইয়া থাকে। মেয়েদের যত দিন পরিবারের আর্থিক বোঝা বলিয়া প্রতিপন্ন করা হইবে, তত দিন কেবল আইন তৈরি করিয়া অথবা ‘বেটি বচাও, বেটি পঢ়াও’ স্লোগান প্রচার করিয়া সরকার নিশ্চেষ্ট থাকিতে পারে না। মেয়েদের সক্ষমতার সার্বিক কর্মসূচি প্রয়োজন। শিক্ষা হইতে সম্পদ, সকলই পৌঁছাইতে হইবে মেয়েদের কাছে। অজাত কন্যাদের বাসযোগ্য করিতে হইবে দেশকে।