বিশ্ব ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৯ সালে ভারতের গড় জাতীয় আয় আজকের দরে ২০০০ মার্কিন ডলারের সামান্য বেশি। তিন দশক আগে, অর্থনীতির উদারীকরণের সময় তা ছিল ৩০০ ডলারের আশেপাশে। উদারীকরণ ভারতীয় অর্থনীতিকে বেশ কিছু দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। কিন্তু আমরা কি এখানেই থেমে যাব?
২০০৫ সালে চিনের গড় জাতীয় আয় ছিল ভারতের সমান— ২০০০ মার্কিন ডলারের সামান্য বেশি। অর্থাৎ, চিন ২০০৫ সালে যেখানে ছিল, ভারত ২০১৯ সালে সেখানে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত চিনের আর্থিক বৃদ্ধি অভাবনীয়। এই দশ বছরে চিনের গড় আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক প্রায় ১০%। ফলস্বরূপ, ২০১৫ সালে, চিনের গড় জাতীয় আয় দাঁড়ায় ৮০০০ মার্কিন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ, এই দশ বছরে চিন গড় জাতীয় আয় চার গুণ করতে সমর্থ হয়। এই অগ্রগতির কয়েকটি প্রধান কারণের একটি হল সার্বিক পরিকাঠামোর অভাবনীয় উন্নতি— যার অন্তর্গত রাস্তাঘাট, রেল যোগাযোগ আর বিদ্যুৎ। এ ছাড়া অনাবাসী চিনা ব্যবসায়ীদের ব্যাপক বিনিয়োগ, সুলভ শ্রমিক এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করে, সেখানে বাধাহীন উৎপাদন চিনকে বিশ্ববাজারে অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে শ্রমিকদের ও শ্রমের অপব্যবহার ও শোষণের সম্ভাবনা থাকে। সেটা হয়তো হয়েছেও। এই নিয়ে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ ও অন্যদের আপত্তি যুক্তিযুক্ত। কিন্তু অপ্রিয় সত্য হল, এতে হরেদরে চিনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক লাভই হয়েছে। এবং, এই লাভের সুফল সেই সব শ্রমিক, তাঁদের পরিবার এবং পরবর্তী প্রজন্মও পাবেন। বেসরকারি পুঁজির উপর নির্ভর করতেও পিছপা হয়নি কমিউনিস্ট চিনা সরকার এবং বাজার নামক প্রতিষ্ঠানটিকেও সম্পূর্ণ ভাবে ব্যবহার করেছে তারা।
এখন ভারত সেই মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত, যখন আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরের ধাপে যাওয়ার কথা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ঠিক এই সময় আমরা প্রথমে বিশ্ববাজারে মন্দা আর এখন করোনা অতিমারির কবলে পড়েছি। কিন্তু ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বর্তমানে মানুষের হাতে টাকা নেই, থাকলেও তাঁরা খরচ করছেন না, ফলে চাহিদার অভাব। এই অবস্থায় চাহিদা বাড়ানোটাই সরকারের প্রধান কাজ। এটা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিশেষ দ্বিমত নেই। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-এ সরাসরি টাকা দেওয়া, প্রয়োজনে টাকা ছাপিয়ে অর্থের জোগান দেওয়া জরুরি, যাতে লোকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে এবং চাহিদার সমস্যা কমে, এই জাতীয় পদক্ষেপের কথা সবাই বলেছেন। আমি সে প্রসঙ্গে বিশেষ ঢুকব না। তবে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে যে রাজস্ব নীতির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না, এটা স্পষ্ট। এর জন্য সরকারের উচিত পরিকাঠামোতে অনেকটা বরাদ্দ করা, যা একাধারে কর্মসংস্থান বাড়াবে, আবার চাহিদাও বাড়াবে। সরকার এই বিষয়ে এখনও যথেষ্ট করেনি, আরও করা দরকার। বর্তমানে বেসরকারি বিনিয়োগ কম, অর্থাৎ ঋণের চাহিদা কম, তাই ব্যাঙ্কে প্রচুর টাকা রয়েছে, যা তারা রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে জমা রেখেছে। সেই অর্থ সরকার চাহিদা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করতেই পারে।
আমি সমস্যাটাকে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিতে দেখতে চাই। করোনা আবহ পেরিয়ে গেলে এবং বাজারে চাহিদা আবার ফিরে এলে, আমরা কোন স্তরে ফিরে যাব? আমরা কি ২০১৯-এর স্তরে ফিরে গিয়ে আত্মতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলব? না কি, খাদের অতল থেকে আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর (যাকে ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের আকৃতির রেখচিত্র দিয়ে দেখানো হচ্ছে) আরও উন্নততর স্তরে যাওয়ার চেষ্টা করব? প্রথম বিকল্পটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটির স্বপ্ন যদি আমরা না দেখি, তা হলে আমরা মানসিক ভাবে পরাজিত বলতে হবে। কিন্তু এটি সম্ভব হবে তখনই, যখন আমরা জোগানভিত্তিক কিছু পদক্ষেপ করব।
জোগানভিত্তিক পদক্ষেপ কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি, মানে আজকের বিনিয়োগের পূর্ণ সুফল পেতে বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। করোনা আবহে ভারত সরকার কিছু জোগানভিত্তিক পদক্ষেপ করেছে। মাঝারি মানের ব্যবসা ও ছোট ব্যবসার জন্য একগুচ্ছ ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে তারা সহজে ঋণ পেতে পারে এবং ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ানোর সংস্থান করে রাখতে পারে; কৃষকদের জন্য সহজ কিস্তিতে ঋণ; পরিকাঠামো উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ; কারখানাজাত উৎপাদন শিল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো; এবং খনি, উৎপাদন-শিল্প, বিমান-শিল্প এবং প্রতিরক্ষায় কাঠামোগত পরিবর্তন ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য দরজা আরও খুলে দেওয়া। সিদ্ধান্তগুলি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এগুলির মাধ্যমেই প্রাক্-কোভিড অবস্থায় প্রত্যাবর্তন এবং তার পরবর্তী আর্থিক প্রগতির সম্ভাবনার পথ খোলা রাখা আছে। তবে সরকার যতটুকু করেছে, তা যথেষ্ট নয়। আগেই বলেছি যে, পরিকাঠামোতে বরাদ্দ যেমন কর্মসংস্থান ও চাহিদা বাড়ায়, তেমনই বাজারের কার্যক্ষমতাকে বাড়াতে সাহায্য করে এবং জোগানের সমস্যাও মেটায়। তাই পরিকাঠামোতে যথেষ্ট বরাদ্দ আবশ্যক।
শ্রম আইনকে একটু নমনীয় করার জন্য অনেক প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ সওয়াল করেছেন। দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তার পর সম্প্রতি সরকার শ্রম আইন সংস্কার করল, যাতে চাকরির নিরাপত্তা হ্রাস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটি খুবই বিতর্কিত একটি বিষয়। শ্রম আইনকে নমনীয় করার সঙ্গে শ্রমিকদের ও শ্রমের অপব্যবহার ও শোষণের সম্ভাবনাটি চলে আসে। এটির সঙ্গে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সমস্যার কিছুটা ধারণাগত সাযুজ্য রয়েছে। এ বিষয়ে সাবধানে পা ফেলতে হবে। শ্রম আইনকে নমনীয় করা জরুরি, কিন্তু শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নও ভুললে চলবে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এত ক্ষণ জোগান নিয়ে কথা বললাম, কিন্তু চাহিদা কি সত্যিই এত বাড়বে? আসলে চাহিদা আর জোগানের মধ্যে একটি যোগসূত্রও আছে। চাহিদা বাড়লে জোগান বাড়ে, জোগান বাড়লে জাতীয় আয় বাড়ে, তার থেকে আবার চাহিদা বাড়ে। এই চক্র যদি ঠিকঠাক চলে, তা হলে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গেই জোগানকে বাড়তে হবে। যদি ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ানোর সংস্থান না থাকে, তা হলে এই চক্র আটকে যাবে। তাই ভবিষ্যৎ-জোগান বৃদ্ধির সংস্থান থাকা জরুরি। বেসরকারি বিনিয়োগ যাতে কমে না যায়, তার জন্যও সরকারকে সম্ভব হলে কর-সুবিধা দিতে হবে। বিনিয়োগ এবং ভবিষ্যৎ জোগানের পথ যেন বন্ধ না হয়।
কিন্তু জাতীয় আয় বৃদ্ধিই কি সব? সামাজিক বিনিয়োগ যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের ব্যবস্থা কী হবে? সে দায়িত্ব অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে। তবে আর্থিক প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অনেক সামাজিক সমস্যা আপনা থেকেই কমে আসে। এই ব্যাপারে আমি অ্যাডাম স্মিথ-এর অদৃশ্য হাতে বিশ্বাসী। প্রাক্-উদারীকরণ আমলে আমরা শিক্ষা বা স্বাস্থ্যে যা সুবিধা পেতাম, আর এখন যা পাই, তুলনা করলেই এটা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। কেউ যদি বলেন প্রাক্-উদারীকরণ পর্বে আমরা ভাল ছিলাম, আমি অন্তত মানতে রাজি নই। তাই, গড় জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলে তার সঙ্গে বেশ কিছু সামাজিক সমস্যাও হ্রাস পাবে। আর অসাম্য? এটিও একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানেও দায় সরকারের। কিন্তু, যদি অসাম্য পুরোপুরি না-ও যায়, ২০০০ ডলার গড় আয়ের অর্থনীতির অসাম্যের চেয়ে ৮০০০ ডলার গড় আয়ের অর্থনীতির অসাম্য কখনও খারাপ হওয়ার কথা নয়, যদি আপেক্ষিক ভাবেও দেখি। তাই অসাম্য থাকলেও মোটের উপর সবাই তুলনামূলক ভাবে ভালই থাকবেন আশা করি।
চিনের মতো দেশের পক্ষে যে কোনও প্রকল্পের বাস্তবায়ন যতটা সহজ, আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশে তা অতটা সহজ নয়। তাই, চিন স্বল্প সময়ে যা পেরেছে, আমরা হয়তো অতটা পারব না। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর জনগণের সামনে দাঁড়াতে হয়। এটি যেমন গণতন্ত্রের একটি শক্তি, আবার দুর্বলতাও বটে। তাই, চিন যা পেরেছে, আগামী দশ বছরে আমরা যদি তার ৭০% অর্জন করে উঠতে পারি, তা হলে সেটাও কম কথা হবে না। ২০৩০-এ আমরা যদি গড় জাতীয় আয় তৎকালীন মার্কিন ডলারের নিরিখে অন্তত ৬০০০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছতে না পারি, তা হলে সেটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক হবে। এক স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটবে।
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়