সেই পুরনো অস্ত্রে শান
TMC

কৃষক ও সংখ্যালঘু দুই শিবিরকেই বার্তা দিতে চায় তৃণমূল কংগ্রেস

কৃষি বিল নিয়ে রাজ্যসভায় যা ঘটল, তা অবশ্যই জাতীয় রাজনীতির উৎকৃষ্ট উপাদান। বিরোধী শিবির সম্মিলিত ভাবে পদক্ষেপ করলে তার গুরুত্বও বাড়বে।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:৩৫
Share:

দূরত্ব: রাজ্যসভায় বাদল অধিবেশনে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর নিয়ম মেনে উপস্থিত সাংসদরা, দিল্লি, ২৩ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।

রাজনীতির রণাঙ্গনে কোন অস্ত্রে কতটা ‘কাজ’ হতে পারে, সব সময় তা আগাম বোঝা যায় না। ‘অস্ত্র’ কখনও অনায়াসে হাতে চলে আসে, কখনও ঘষে মেজে শান দিয়ে তাকে তৈরি করে নিতে হয়। তবে কে কোনটি কী ভাবে ব্যবহার করবে, তা সাধারণত যার যার নিজস্ব বিবেচনার উপর নির্ভরশীল। আর সেটাই হল সবচেয়ে বড় জিনিস।

Advertisement

ভোটমুখী বাংলায় শাসক তৃণমূল কংগ্রেস সহসা দু’টি হাতিয়ার পেয়েছে। দু’টিই অবশ্য এর আগে ব্যবহৃত। তবে তখন পরিপ্রেক্ষিত এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল অন্য। এখন সেগুলিকে আবার নতুন ভাবে কাজে লাগানোর ‘মওকা’ পেয়ে গিয়েছে তারা। নেমেও পড়েছে। একটি সংসদে সদ্য পাশ হওয়া কৃষি বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন। অপরটি রাজ্যে বিজেপির ‘বি-টিম’ হিসাবে কংগ্রেসকে তুলে ধরা।

কৃষি বিল নিয়ে রাজ্যসভায় যা ঘটল, তা অবশ্যই জাতীয় রাজনীতির উৎকৃষ্ট উপাদান। বিরোধী শিবির সম্মিলিত ভাবে পদক্ষেপ করলে তার গুরুত্বও বাড়বে। তবে মমতা অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে গোড়া থেকেই যে ভাবে নেমেছেন এবং বৃহত্তর আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেছেন, তার পিছনে রাজ্য রাজনীতিরও একটি অঙ্ক আছে। সোজা কথায় তা হল, ভোটের অঙ্ক।

Advertisement

তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, ‘‘কৃষককে লুট করতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই বিল পাশ করাল।’’ যার সহজ অর্থ, বিজেপি কৃষক-বিরোধী। মমতা এ বার গ্রাম বাংলায় এই প্রচারই ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল নেবেন। এ বিষয়ে তিনি অভিজ্ঞও বটে।

ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলন সংগঠিত করে তিনি কী ভাবে রাজ্যের সিপিএম সরকারকে উৎখাত করার পথ প্রশস্ত করতে পেরেছিলেন, তা চির দিন মনে রাখার। দু’টি ক্ষেত্রেই মূল বিষয় ছিল একই— ‘জমি রক্ষা’। এর ফলে রাজ্যে শিল্প-সম্ভাবনা ঘা খেলেও ‘কৃষক-স্বার্থে’ মমতার লড়াই সিপিএমের গ্রামের ভোট ব্যাঙ্ক ধসিয়ে দিয়েছিল। কারণ তিনি বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন, সিপিএম কৃষকদের ‘বন্ধু’ নয়।

এ বার নয়া কৃষি আইন দেখিয়ে রাজ্যের শাসক মমতা যখন কেন্দ্রের শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে একই ভাবে একই কথা বলে মাঠে নামবেন, তখন তা একেবারে বিফলে যাবে, তা বলা এখনই হয়তো ঠিক হবে না। উপরন্তু এ ক্ষেত্রে বাম এবং কংগ্রেসের পক্ষেও বিষয়টির সরাসরি বিরোধিতা করা কঠিন। সুতরাং প্রথম সুযোগেই কৃষকদের ‘স্বার্থরক্ষা’র দাবিতে এই আন্দোলনের লাগাম ধরার পিছনে মমতার নিজের ভোটের ভিত মজবুত করার বাড়তি উদ্যোগ থাকা অমূলক নয়। তিনি তা-ই করছেন।

এ বার বি-টিম প্রসঙ্গ। বাংলার রাজনীতিতে ‘বি-টিম’ কথাটি ব্যঞ্জনাময়। নিন্দার্থেই। নব্বই দশকের অনেকটা জুড়ে এই ব্যঞ্জনাটি অদৃশ্য ভূতের মতো রাজ্য রাজনীতির ঘাড়ে চেপে বসে খুঁটি নাড়িয়ে দিয়েছিল। আসলে এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আসল-নকল, সততা-মিথ্যাচারের লড়াই। তাতে তৈরি হয়েছিল উত্থান-পতনের নতুন রেখচিত্র। তারই পরিণামস্বরূপ বাংলায় কংগ্রেসি রাজনীতির চাকা ঘুরে যায়। আসে আমূল পরিবর্তন।

এ বার অবশ্য ‘বি-টিম’ রবের প্রেক্ষাপট বদলেছে। রাজনৈতিক সমীকরণও আলাদা। কিন্তু তারই মধ্যে ‘বি-টিম’ ভাবনাকে ফের জাগিয়ে তুলতে তৃণমূলের একটি সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা নজর এড়ায় না।

ঘটনাচক্রে আগের মতোই দুই পক্ষে কংগ্রেস ও মমতা। রাজ্যের কংগ্রেস ফের অভিযুক্তের কাঠগড়ায়। তার দিকে আঙুল তুলছেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বস্তুত মমতাই প্রথম ‘বি-টিম’ বিষয়টিকে রাজনৈতিক ভাবে অর্থবহ করে তুলেছিলেন। যার ফল ভোগ করতে হয় কংগ্রেসকে। তৃণমূল গড়ার প্রাক্-পর্বে অর্থাৎ কংগ্রেস ছেড়ে বেরোনোর আগে মমতা তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বকে সিপিএমের বি-টিম বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেস সমর্থক জনতার সায় মিলেছিল।

তৃণমূল কংগ্রেস নাম নিয়ে তিনি যখন কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, তখনও সেটাই ছিল তাঁর মূল প্রতিপাদ্য। তিনি ডাক দিয়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেসকে সিপিএমের ‘কবলমুক্ত’ করার। সেই আহ্বান থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম। তার উত্থানও কংগ্রেসকে ভাঙতে ভাঙতে। এ বার ‘বি-টিম’ ফিরে এল রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির গোপন বোঝাপড়ার অভিযোগ নিয়ে। রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন সে দিন সরাসরি বলেছেন, মমতাকে হারাতে কংগ্রেস তলায় তলায় বিজেপির সঙ্গে যোগসাজশ করছে। বাংলায় তারা বিজেপির বি-টিম। তাঁর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য প্রদেশ কংগ্রেসের নবনিযুক্ত সভাপতি অধীর চৌধুরী।

সংসদে চিন নিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর গা-বাঁচানো বক্তব্যে ওই দিন কংগ্রেস-সহ সম্মিলিত বিরোধী শিবির যখন প্রতিবাদ করেছে, তৃণমূলের ‘নীরব’ ভূমিকা তখন স্বাভাবিক ভাবেই নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে সেটিই ছিল তৃণমূল সাংসদের ওই মন্তব্যের প্রেক্ষিত। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে এর পিছনেও সুচিন্তিত এক রাজনৈতিক কৌশল খুঁজে পেতে হয়তো অসুবিধা হবে না। আগামী নির্বাচনের সঙ্গে তারও অর্থবহ যোগ আছে।

বস্তুত তৃণমূল-বিরোধিতার প্রশ্নে বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিএমকে এক বন্ধনীতে এনে মমতা তাদের প্রায় নিয়মিত ‘জগাই-মাধাই-বিদাই’ ইত্যাদি বলে কটাক্ষ করে থাকেন। এর মধ্যে ঠিক-ভুল বিচার করতে যাওয়ার অর্থ নেই। কারণ, প্রয়োজন অনুযায়ী রাজনীতি তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। সব দলের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।

তবে অধীরবাবু প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্ব নেওয়ার পরে কংগ্রেসকে এই ভাবে বিজেপির ‘বি-টিম’ বলার মধ্যে অন্য একটি তাৎপর্যও নিহিত আছে। মুর্শিদাবাদের এই জাঁদরেল কংগ্রেস নেতার সঙ্গে বিজেপির ‘সম্পর্ক’ বিষয়ে রাজনীতির অঙ্গনে জল্পনার বিরাম নেই। বিষয়টি এক সময় এমন স্তরে পৌঁছেছিল যে, তাঁর বিজেপি-তে চলে যাওয়ার দিন গোনা হত নানা মহলে। কিন্তু যুক্তি অতিক্রম করে তর্ক আজও বহু দূর গড়ায়। অধীর চৌধুরী লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা হওয়ার পরেও সেই চর্চায় একেবারে ছেদ পড়েছে, তা বলা যাবে না। আর কে না জানে, এ সব সত্য-মিথ্যার বিবাদভঞ্জন করা অতি দুরূহ কর্ম। অতএব ও কথা থাক।

যা প্রকাশ্য তা হল, অধীরবাবুর তৃণমূল-বিরোধী অবস্থান। মমতা যখন কংগ্রেসে ছিলেন, তখনও অধীরের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সখ্য ছিল না। অধীরও মমতাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে রাজনীতি করেছেন। মূলত মুর্শিদাবাদের নেতা হিসাবেই তখন পরিগণিত হতেন অধীর। মমতা তৃণমূল তৈরি করার পরে নানা সময়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক বোঝাপড়া হলেও অধীরের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব ঘোচেনি। অনেকের ধারণা, নিজের ‘সাংগঠনিক দক্ষতার’ উপর অধীরবাবুর আস্থা এর এক বড় কারণ।

এর আগেও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হয়ে রাজ্যের কংগ্রেসকে শাসক তৃণমূলের বিরোধিতায় উদ্বুদ্ধ করেছেন অধীর চৌধুরী। এ বারেও রাজ্যের কংগ্রেস সেই পথে। সিপিএমের সঙ্গে জোটের পথও খোলা। একই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, জাতীয় স্তরে বিরোধী মঞ্চে কংগ্রেস ও তৃণমূল একত্র হলেও রাজ্যে তার প্রতিফলন ঘটবে না।

এ ক্ষেত্রে ভোটের ভারসাম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়। বিজেপির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু ভোটের কিয়দংশও যদি কংগ্রেস টেনে নেয়, তাতে মমতার ঝুলিতে আগে টান পড়বে। বিশেষত এ বারের ভোটে এটা যথেষ্ট উদ্বেগের। এই বাস্তবতার নিরিখে রাজ্যের কংগ্রেসকে বিজেপির ‘বি-টিম’ বলে প্রচার করা ভোটযুদ্ধে তৃণমূলের এক সুচিন্তিত কৌশল। সংখ্যালঘুদের মধ্যে এই প্রচার যাতে ছায়া ফেলে, উদ্দেশ্য সেটাই।

এ ভাবেই দু’টি পুরনো অস্ত্রকে আবার নতুন করে কাজে লাগানোর উদ্যোগ বাড়ছে। কোন অস্ত্রের ধার কেমন, বলবে ভবিষ্যৎ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement