হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, বলা কঠিনই আজ!

উৎসব আসে। ছুটির পরিসর তৈরি হয়। প্রতিদিনের ছকে বাঁধা বেঁচে থাকার বাইরে একটু অন্য ভাবে বাঁচার ইচ্ছাও জাগে। কিন্তু উদ্‌যাপনের কাঙ্ক্ষিত অবকাশ কি আছে এই অদ্ভুত সময়ে?

Advertisement

চন্দন মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৯ ০০:১২
Share:

একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে, মনে আছে। খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল, সম্ভবত হোর্ডিংয়েও দেখেছিলাম। তবে বিজ্ঞাপিত বস্তুটি কী, তা ঠিক মনে নেই। সম্ভবত সংবাদপত্রেরই নিজস্ব বিজ্ঞাপন। যেটা মনে আছে, তা হল, শহরে (কলকাতা হতে পারে) পড়াশোনা করা একটি মেয়ে পুজোর ছুটির অবকাশে বাড়ি ফিরছে। নিশ্চয় তার বাড়ি মফস্‌সলের কোনও ছোট শহরে এবং অবশ্যই নদীর কাছাকাছি। কারণ, বিজ্ঞাপনে সেই ইঙ্গিত ছিল। বেশ ছিমছাম সৃজনশীল সেই বিজ্ঞাপনটির পরিবেশন এবং ভাষা। সাদা-কালো ফোটোগ্রাফিতে তরুণীর ‘শিলুয়েটায়িত’ মুখ, সম্ভবত ট্রেন বা বাসের জানলায়। আলো-আঁধারির নৈপুণ্যে ঋদ্ধ, সেই সঙ্গে বাংলায় লেখা ছোট্ট একটা শুধু ‘ক্যাচলাইন’! ব্যস! তাতেই কেল্লা ফতে! অনেকদিন পর ছুটিতে বাড়ি ফেরার পাগল করা অনুভূতিটা যেন পরম মমতায় আঁকা ছিল ওই সাদা-কালো ছবিটা জুড়ে। ওইটুকুতেই! একই ভাবে এক তরুণের ছবিও ব্যবহার করা হয়েছিল ওই বিজ্ঞাপনটিতে। খুব মনে ধরেছিল বিজ্ঞাপনটা। হয়তো আমি মফস্‌সলের ছেলে বলেই।

Advertisement

বিজ্ঞাপনটির ছবি আর তার ভাষায় মুগ্ধ আমার কল্পনার ডানা মেলেছিল এই ভাবে— মেয়েটি বা ছেলেটির বাড়ি হতে পারে জলপাইগুড়ি বা ঝাড়গ্রাম অথবা কৃষ্ণনগরে। হতে পারে তার বাড়ি মূর্তি, জলঙ্গি, তিস্তা, কাঁসাই অথবা ডুলুং নদীর কাছে। ফিরেই সে তার সাইকেলটা নিয়ে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে নদীর ধারে, নির্জনতায়। হয়তো সে একাই ঘুরবে। অথবা অনেকদিন পর দেখা হবে তার প্রিয় বন্ধু বা বান্ধবীটির সঙ্গে। নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে অবকাশের ছলে নিজেকে মেলে ধরার এ তো এক মগ্ন উদ্‌যাপন। সেটা তো শুধু ফেরা নয়, সে এক আশ্চর্য ভ্রমণ। এসব ভেবে খুব লোভ হত বিজ্ঞাপনটি দেখে। এসব শুনেটুনে আমার দিল্লিবাসী এক পুরনো সহকর্মী তথা বোহেমিয়ান বন্ধুটির সকৌতুক প্রশ্ন— আমার কল্পিত সেই উদ্‌যাপনের অবকাশ কি এখন আর আছে।

তারপর অনেক কথাই হল বন্ধুটির সঙ্গে। সত্যিই তো! ঘটনাচক্রে সাংবাদিকতার পেশায়। তাই প্রতিটা দিন চোখের সামনে ভেসে ওঠে শুধু দুর্ভাবনার খবর। পাশাপাশি, রাজনীতি, অর্থনীতি, গণতন্ত্র মায় প্রাত্যহিক যাপনেও বিপন্নতার ছবি। সেই বিপন্নতা নিয়ে নিত্য কাটাছেঁড়া। তবে এই বিপন্নতা নিয়ে আলোচনা হয় সমাজের সর্বত্রই। অফিসে, চায়ের দোকানে, ট্রেনে-মেট্রোয়, এমনকি বেড়াতে গিয়েও ঘুরেফিরে একই আলোচনা। কিন্তু এই বাধ্য অভ্যেস কখন যে আমাদের ব্যক্তিসত্তাকে গিলে খেতে শুরু করেছে, আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। বুঝতে চাইও না। তাই সকালে উঠে বাড়ি আর কর্মক্ষেত্রের ভাবনার পাশাপাশি আমরা বই পড়তে ভুলে গিয়েছি। ভুলে গিয়েছি ভাল লাগার গান শুনতে, নাটক দেখতে। ভুলেছি কলমটা দিয়ে সাদা কাগজে কিছু লিখতে। ভুলেছি এক সদ্য তরুণ বা তরুণের সপ্রতিভ মুখ দেখে আবার প্রেমে পড়ার ইচ্ছে করতে বা কারও জন্য অনেক অনেকদিন অপেক্ষা করতে। তাই আজ এমন কোনও মেয়ে বা ছেলে সেই চেনা চিত্রনাট্যের বাইরে কোনও চরিত্র নয়।

Advertisement

ফলে, একলা ছেলেটি অনেকদিন পর বাড়ি ফিরে নির্জন নদীর ধারে ঘোরাফেরা করছে। এই দৃশ্য ভাবলেই আমাদের পেশাগত ‘দৃষ্টি’তে শঙ্কার মেঘ জমে। বছর দু’য়েক আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নির্জনতার খোঁজে বেরিয়েছিল এমনই এক তরুণ এবং তাঁকে গরুচোর সন্দেহে অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। তারপর থেকে আমাদের এই রাজ্যে আরও কত গণপিটুনি, গণহত্যার ঘটনা এ ভাবে ঘটেছে, সংবাদপত্রের অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে আমরা দেখেছি। আমরা টিভির পর্দায়, কাগজের পাতায় প্রতিদিনই দেখছি, আজও নদীর ধারে একলা তরুণীর নির্জনতা উদ্‌যাপন মোটেও নিরাপদ নয়।

আমাদেরই অফিসের এক কনিষ্ঠ সহকর্মী পুজোর কয়েকদিন বেশি ছুটি চেয়েছেন। তিনি জানালেন, পুজোর প্রাপ্য ছুটির পর তাঁকে শিলিগুড়ির বাড়িতে আরও কয়েকটা দিন থাকতে হবে। কারণ, বাবা-মায়ের ডিজিটাল রেশন কার্ডে নামের ভুল বানান সংশোধন করাতে হবে। সহকর্মীর বাবা-মায়ের মনে ভয় ধরেছে, এনআরসির জন্যই এত তৎপরতা। কখন কী হয়, কে জানে! সহকর্মী বাবা-মাকে অনেক বুঝিয়েও পারেননি। কিন্তু আমার সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, কিছুটা উদ্বেগ তাঁকেও গ্রাস করেছে। সত্যি! আমাদের এখন ‘ভূতে’ পেয়েছে। ভয়ের ভূত। দেশ জুড়ে, বাড়ি জুড়ে, মন জুড়ে ভয়ের ভূত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যেন। কারও চেতনে, কারও অবচেতনে। আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত মনে করি, তারা জানি-বুঝি, কে বা কারা আমাদের মনের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে এ-চালে ও-চালে ভয় নামক ঢিল মারে। আমরা প্রতিবাদটুকু করতে ভয় পাই। পরিবর্তে আমরা নিজেকে সান্ত্বনা দিই। আশায় থাকি, হয়তো কিছু হবে না। চালে কখনও কখনও ঢিল পড়া হয়তো সাময়িক বন্ধ হয়। কিন্তু আমরা এমনই বুদ্ধিমান যে, সেই ‘চাল’টাও ধরতে পারি না। অতএব, জেনেবুঝে ভয় পেতেই থাকি, পেতেই থাকি। কখন যে আত্মসমর্পণের জন্য ফের ভয়ের দরজাতেই কড়া নাড়ি, বুঝতেও পারি না।

ডাকঘরের সামনে প্রতি মাসে সাতসকালে কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ভিড় চোখে পড়ে। সারা জীবনের সংগ্রাম সামলে যেটুকু যৎকিঞ্চিৎ জমিয়েছেন, সেটাই পরম আশায় রেখেছিলেন ডাকঘরে। অবসরের পর সুদসমেত সামান্য কিছু মাসিক আয়ের আশায়। যদিও তা দিয়ে অবশ্য আজ একজনের সারা মাসে দু’বেলা ভাল করে খাবারও হয় না। কিন্তু সেই নিশ্চিন্ত চড়ুই-সঞ্চয়েও ভয়ের ভূত হানা দিয়েছে। প্রতি বছরই সুদ কমছে স্বল্প সঞ্চয়ে। করুণ মুখ করে একদল বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সেটুকুই নিতে দাঁড়িয়ে থাকেন বন্ধ ডাকঘরের দরজায়।

আজও কোনও তরুণ, কোনও তরুণী বাসে ওঠে, ট্রেনে ওঠে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে বাড়ি ফেরার জন্য। কারও বাবা-মা অপেক্ষা করে আছেন, কখন মেয়ে নিরাপদে ফিরবে। কবে ছেলেটা আসবে, তাঁদের ভোটার কার্ড সংশোধনের কাজটা করে দেবে।

আশা জাগে না। শুধু আশঙ্কার উত্তরীয় উড়ে বেড়ায় বাতাসে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement