নেতৃত্ব: নন্দীগ্রামে শাসকশক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের মৌনী প্রতিবাদ-মিছিল, কলকাতা, ৯ মে, ২০০৮
দেশের উনপঞ্চাশ জন বিখ্যাত মানুষ প্রধানমন্ত্রী মোদীকে চিঠি লিখলেন অত্যন্ত সঙ্গত বিষয়ে। এঁদের মধ্যে যখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আদুর গোপালকৃষ্ণন, অপর্ণা সেন, মণিরত্নম বা কৌশিক সেনদের নাম দেখি, তখন অবশ্যই গুরুত্বসহকারে তা বিবেচনার দাবি রাখে। প্রধানমন্ত্রী তা করবেন কি না সেটা স্বতন্ত্র বিষয়। কিন্তু নাগরিক সমাজের এই সক্রিয়তাকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না। এই বিখ্যাত মানুষেরা প্রত্যেকেই দীর্ঘ দিন একনিষ্ঠ ভাবে নিজেদের কাজের ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করেছেন। দেশকে বুঝতে চেয়েছেন নিজেদের মতো করে। দেশের মানুষকে ভালবেসে নির্মাণ করেছেন অনবদ্য শিল্প। মণিরত্নম আমাদের প্রথম দেখিয়েছিলেন কী ভাবে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও প্রেমের দাবির কাছে মাথা নত করে। দেখিয়েছিলেন কী ভাবে দাঙ্গা পরিস্থিতিতেও হিন্দু-মুসলিমের মিলন অটুট থাকে। দেখিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ কী ভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। অতএব আজ নতুন যে বিপদ ঘাড়ে এসে পড়েছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে চিঠি এই কৃতী মানুষগুলি দিয়েছেন, তা প্রয়োজন ছিল।
তাঁরা কী বলছেন, মন দিয়ে শোনা জরুরি। হ্যাঁ, ঠিকই, দলিত ও মুসলিমদের উপর বর্ণহিন্দুর অত্যাচার এ দেশে নতুন নয়। উত্তর এবং মধ্যপ্রদেশের ‘বাগী’রা প্রকৃত অর্থেই এই অত্যাচারের প্রতিস্পর্ধী রূপ। এটি পুরোপুরি হিন্দুত্ববাদীদের আমদানি এমনটা মনে করলে ভুল হবে। কিন্তু সন্দেহ নেই, সমাজের গভীরে যে বর্ণহিন্দুর আধিপত্য ছিল, তাকে আরও বেগবান করেছে একমাত্রিক রাজনীতি। জাতীয়তাবাদী চিন্তা সমস্যাজনক নয়, কিন্তু তা যদি স্বাধীন দেশেও সহিংস থাকে, তা হলে চিন্তার কারণ আছে বইকি। কার বিরুদ্ধে এত যুদ্ধ? ডান, বাম, কেন্দ্রপন্থী তো সব দেশেই আছেন। নির্বাচনী যুদ্ধ বা রাজনৈতিক মতাদর্শগত লড়াই অব্যাহত সর্বত্রই। কিন্তু কোনও সভ্য স্বাধীন দেশে বিরুদ্ধ মত পোষণের জন্য কাউকে ‘দেশবিরোধী’ আখ্যা তো সহসা দেওয়া হয় না! প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন উন্নত ভারত, ‘সবকা বিশ্বাস’। ভাল কথা, কিন্তু তা প্রয়োগ করার জন্য রাষ্ট্রীয় স্তরে প্রস্তুতি কোথায়? ‘আরবান নকশাল’দের নিকেশ করার জন্য যে বিল আনল কেন্দ্র, তাতে তো এই বিরুদ্ধবাদীদেরই চুপ করানোর কলকৌশল। স্রেফ সন্দেহের বশেও কাউকে গ্রেফতার করা যাবে— এমন দমনমূলক পদক্ষেপ তো সেই পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ রাজের রাওলাট বিল-এর মধ্যে ছিল। রাজনীতি বা রাষ্ট্রশক্তিকে প্রশ্ন করার অবকাশটুকুও এই ভাবে আজ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্যই জরুরি ছিল এমন পরিসর তৈরি, যেখানে স্বাধীন ভাবে সবাই মত প্রকাশ করতে পারবেন। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রগুলি খোলামেলা আলোচনা বা পঠনপাঠনের ক্ষেত্র হতে পারবে। সেখানে সব রকম মতামত উঠে আসবে, মতামতের চর্চা চলবে। এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতেন রাষ্ট্র পরিচালকেরাই। রাষ্ট্রীয় নীতি স্থির করতে তাঁদের সুবিধা হত। একমাত্রিক মনগড়া কথাবার্তা না বলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা কৃতী, তাঁদের একত্রিত হতে দিলে ‘জয় শ্রীরাম’-এরও হয়তো ক্ষতি হত না।
এই চিঠি জরুরি ছিল। কিন্তু তবুও আজ এমন চিঠি বা এমন বার্তা দিয়ে এই অসহিষ্ণুতাকে আটকানোর পথে একটুও এগোনো যাবে কি না, জানি না। আসল কথা, সমস্যা তো এই আমাদের মতো মানুষদের নিয়েও। আমরা যারা আজ নাগরিক সমাজের এই স্বাধীনতা চাইছি, বরাবরই কি আমরা একই ভাবে তা চেয়েছি? প্রশ্নটা উঠত না যদি আমরা বাংলাদেশের মতো নাগরিক সমাজের একটি স্থায়ী বিকল্প পরিসর তৈরি করতে পারতাম। বাংলাদেশ একটি মুক্তিযুদ্ধই শুধু দেখেনি, তার একটি সবল প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল। ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ঐতিহ্য আর আত্মত্যাগ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ কখনওই সম্ভব হত না। স্বাধীন বাংলাদেশেও সমস্যা কিছু কম ছিল না— মুজিব হত্যা, সামরিক শাসন, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার। কিন্তু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মরিয়া লড়াই কখনওই সম্ভব হত না যদি একটি স্বাধীন নাগরিক সমাজ সেখানে না থাকত। তাদের সেই নাগরিক সমাজের জোরটা কি আমরা আজও অস্বীকার করতে পারি? একের পর এক লেখক, ব্লগার সেখানে আক্রান্ত ও নিহত হয়েছেন। অথচ তাঁদের লড়াই থামেনি।
যদি সত্যি আমরা একটি হিংসামুক্ত পরিবেশ চাই, তবে প্রয়োজন সংগঠিত উদ্যোগ। কোনও দলীয় আশীর্বাদ ছাড়াই সেই উদ্যোগ তৈরি করা দরকার। ধারাবাহিক ভাবে কিছু কাজ করা দরকার, যার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়বে সমাজজীবনে। সিনেমা সাহিত্য নাটক সর্বত্রই তা ফুটে উঠবে। আমাদের সাহিত্য সেই ধারা বহন করছে হয়তো, সংবাদ সাহিত্যেও তার প্রতিফলন ঘটছে। কিন্তু তার বাইরেও কি সমাজের আরও কিছু দায় ছিল না?
আমাদের কাজে ধারাবাহিকতার অভাবও খুব বেশি। যখন একটি বিপর্যয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন আমরা প্রতিবাদ করি, কিন্তু সেই প্রতিবাদের কোনও ধারাবাহিকতা থাকে না। উল্টো দিকে, সঙ্ঘ পরিবার ধারাবাহিক ভাবে সক্রিয় থাকে তার নিজের মতপ্রকাশে, কিংবা সংগঠিত সামাজিক বিভাজন ঘটাতে। আমাদের অগোছালো প্রস্তুতিহীনতা সেই বিভাজনকার্যে ইন্ধন জুগিয়েছে মাত্র। সঙ্ঘ পরিবার সে কথা জানে। জানে যে, এ দেশের প্রতিস্পর্ধী স্বর এই প্রস্তুতিহীনতার কারণেই ক্রমে ক্রমে নিবে যাবে।
এ কথা বোঝার জন্য পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। প্রাক্-স্বাধীনতা কালে রবীন্দ্রনাথ বা অন্যরা যে সামাজিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা কিন্তু কোনও দল-নির্দিষ্ট ছিল না। তাঁরা নিজেদের মতো করে ভাবতেন, সমাজচিন্তায় সেই ভাবনার প্রভাব পড়ত। মানুষ তা গ্রহণ করত। স্বাধীনতা-পরবর্তী বেশ কিছু সময় ধরে এই স্বাধীন চিন্তা ও কাজের ধারাটি অব্যাহত ছিল। ষাটের দশক থেকে জন্ম হল একটি বিরুদ্ধ প্রবণতার— দলীয় মতাদর্শের মাপকাঠিতে চিন্তার স্বাধীনতাকে মাপার। বামফ্রন্ট জমানায় তা সংগঠিত রূপ ধারণ করল। সম্প্রতি একটি নিবন্ধে অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন কী ভাবে নাগরিক সমাজের স্বাধীন কার্যকলাপকে ধীরে ধীরে দলীয় শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলল। রাখহরি চট্টোপাধ্যায় এবং পার্থপ্রতিম বসু সম্পাদিত ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল আন্ডার দ্য লেফ্ট’ গ্রন্থে ‘সিভিল সোসাইটি ইনিশিয়েটিভস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নিবন্ধে তিনি বলেছেন, কী ভাবে থিয়েটারের মতো একটি স্বাধীন মাধ্যমকেও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছিল। ফলে, যে থিয়েটার এক সময়ে বাঙালির প্রাণশক্তি ছিল, তা শুকিয়ে আসে। বাম আমলেই গ্রুপ থিয়েটার প্রাধান্য পায়, আবার সব কিছুই দলের সুবিধামতো করার বাধ্যবাধকতা সে সময়েই নাগরিক সমাজের সবচেয়ে বেগবান মঞ্চটিকে সৃষ্টিহীন করে তোলে। প্রশ্নের সংস্কৃতি ফের ফিরে আসে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে। নামে নাগরিক সমাজের ঢল। দলীয় সাহায্য ব্যতিরেকেই সাহসী মুখগুলি সংগঠিত প্রচেষ্টায় নিয়ে এল প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের স্মৃতি। রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে বাধ্য হল। কিন্তু আবারও, পরবর্তী কালে, দলমতের চাপে দলস্রোতের গহিনে ডুবে গেল নাগরিক সমাজের সত্তা।
তাই হয়তো আজ এ রাজ্যে স্বৈরবাদী ভাবাবেগের বাড়বাড়ন্ত প্রতিহত করার জন্য নাগরিক সমাজের দিকে আর কেউ তাকিয়ে থাকে না। আগেকার দিনের সেই ঝুঁকি নিতে-পারা সক্রিয়তার অস্তাচল-গমনের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সমাজের কাছে প্রত্যাশাও সম্ভবত হারিয়ে গিয়েছে।
বঙ্গবাসী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক