প্রতিরোধ: দিল্লি-মেরঠ এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন পঞ্জাবের কৃষকরা, ৪ ডিসেম্বর। পিটিআই
ভুলটা কোথায়? কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা না করেই, সংসদে তর্কের সুযোগ না দিয়েই কৃষি বিলকে আইনে পরিণত করে ফেলা? হরসিমরত কউর যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙে দিলেন, তখনও পঞ্জাবের ক্ষোভের চরিত্র বুঝতে না পারা? মদনলাল খুরানার মতো কোনও নেতা না থাকা, যিনি বিরোধের আভাস পেেলই ছুটতেন প্রকাশ সিংহ বাদলের মান ভাঙাতে?
এই কারণগুলোর সবই ঠিক। ঠিক এই কথাটাও যে, পঞ্জাব-হরিয়ানার এই বিক্ষোভ আসলে মূলত সম্পন্ন চাষিদের— এই রাজ্যগুলোয় যাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি প্রবল। আর সেই কারণেই সম্পন্নরা যখন দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামেন, তার জোর হয় প্রবলতর। হরিয়ানার উপমুখ্যমন্ত্রী দুষ্যন্ত চৌটালা যে কারণে বেসুর গাইছেন, ঠিক সেই কারণেই মনোহর লাল খট্টরের সরকারকে ‘কৃষক-বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন নির্দল বিধায়ক সম্বির সাঙ্গোয়ান— কৃষককুলকে চটিয়ে রাজনীতি করা মুশকিল। মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েতের পরিবারের শরণাপন্ন হয়েছে বিজেপি— অন্তত উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের যাতে হাতে রাখা যায়। কিন্তু, এটুকুই সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নয়।
এই বিক্ষোভ স্মরণকালের মধ্যে সর্ববৃহৎ কৃষক আন্দোলন, অতি তাৎপর্যপূর্ণ কৃষক আন্দোলন। কিন্তু তাকে শুধু কৃষকদের আন্দোলন ভাবলে খণ্ডদর্শন হবে। অভিনেতা থেকে গায়ক, ক্রিকেটার— একের পর এক তারকা পঞ্জাবি এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন প্রকাশ্যে। বিক্ষোভের অভিমুখ নরেন্দ্র মোদীর দিকে, তা জানার পরও। অ-কৃষিজীবী পঞ্জাবিরা এগিয়ে আসছেন বিক্ষোভের সমর্থনে। ট্রাকমালিকদের সংগঠন জানিয়েছে, কেন্দ্র কৃষকদের দাবি না মানলে তারাও ধর্মঘট করবে দেশ জুড়ে।
কার্যত গোটা রাজ্যটাই দাঁড়িয়ে পড়েছে কৃষকদের সমর্থনে, এই ছবি ভারতের আর কোনও প্রান্তে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই একটা জায়গায় পঞ্জাব অনন্য— এখানে সমাজের কেন্দ্রে অবস্থান করে কৃষি। গড়পড়তা কৃষকের জমির মাপ দেশের অন্য যে কোনও প্রান্তের কৃষকের চেয়ে বেশি, ফসল উৎপাদনও বেশি— ফলে তাঁদের হাতে টাকাও বেশি, এটা সেই কেন্দ্রীয় অবস্থানের একটা কারণ, কিন্তু একমাত্র নয়। আরও তাৎপর্যপূর্ণ কারণটি হল, পঞ্জাব এমন একটা রাজ্য, যেখানে গ্রামের মানুষই হোন বা শহরের, এমনকি ভিন্ দেশে প্রবাসীদেরও, কৃষির সঙ্গে যোগসূত্র অতি প্রবল। তাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে কৃষিতে জড়িত না থাকলেও। কারও বাপ-দাদা এখনও চাষ করেন; শহরনিবাসী কারও আয়ের বৃহত্তম উৎস এখনও পারিবারিক ক্ষেত। ফলে, কৃষিক্ষেত্রের আন্দোলনে জড়িয়ে যায় গোটা রাজ্য।
কৃষির এই রাজ্যব্যাপী সামাজিক তাৎপর্য ধরতে না পারা ভুল। যেমন ভুল দেশের একমাত্র শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্রমশ নিরাপত্তার অভাবে ভোগাকে বুঝতে না পারা। এই কৃষক-বিক্ষোভকে যদি বুঝতে হয়, এবং বৃহত্তর অর্থে পঞ্জাবের রাজনীতিকে যদি বুঝতে হয়, তবে শিখ ধর্মকে আখ্যানে না এনে উপায় নেই। মোদী-শাহের রাজনীতি এই শিখ-আবেগে এক গভীর অবিশ্বাস তৈরি করেছে। অবশ্য, ভুলটা তাঁদের, বললে অন্যায় হবে। এই ভুলের বীজ লুকিয়ে আছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হিন্দুত্ববাদী ভারত-চিন্তায়। তাদের চিরকালীন হিসেব, যে ধর্মের উৎপত্তি ভারতবর্ষে, সেই ধর্ম হিন্দুধর্মেরই অন্তর্ভু্ক্ত। বৌদ্ধধর্ম যেমন, জৈনধর্ম যেমন, শিখধর্মও তেমনই। শিখরা মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন— এই ইতিহাস আরএসএস-এর ব্যাখ্যায় হয়ে দাঁড়ায়, শিখরা লড়েছিলেন হিন্দুদের পক্ষে দাঁড়িয়ে, কারণ তাঁরা হিন্দুদের থেকে পৃথক নন। এই ব্যাখ্যায় স্বভাবতই শিখদের আপত্তি আছে। পঞ্জাবে আরএসএস-এর আদর্শের প্রধানতম বিরোধীর নাম অকাল তখত— শিখ ধর্মের সর্বোচ্চ কেন্দ্র।
সাংবাদিক শেখর গুপ্তর এক নিবন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা পড়লাম। পঞ্জাবে তখন জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালেই শেষ কথা। আরএসএস-এর সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেব দেওরস মন্তব্য করলেন, শিখরা তো হিন্দুই। কেশধারী হিন্দু। ভিন্দ্রানওয়ালের প্রতিক্রিয়া ছিল, “ওই নিক্করধারী (অর্থাৎ, হাফপ্যান্ট-ভূষণ) তা হলে মুসলমানদের কী বলবেন, সুন্নতধারী হিন্দু?” প্রসঙ্গত, স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লু স্টার চালানোর সমর্থক ছিল বিজেপি। সেনা পাঠিয়ে ভিন্দ্রানওয়ালেকে শায়েস্তা করার দাবিতে দিল্লিতে ধর্নায় বসেছিলেন বাজপেয়ী-আডবাণী। ২৬ নভেম্বর থেকে চলা কৃষক বিক্ষোভ সম্বন্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে বিজেপির আইটি সেলের বয়ানে যে বারে বারে ‘খলিস্তানি’ প্রসঙ্গ আসছে, সেটা অকারণ নয়— শিখ খণ্ডজাতীয়তাবাদের সঙ্গে আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদের সংঘাত প্রত্যক্ষ।
আরএসএস যত বারই শিখদের আত্মীকরণ করার চেষ্টা করেছে, অকাল তখত প্রতিবাদ করেছে। ২০০২ সালে তখতের সর্বোচ্চ নেতা বলেছিলেন, আরএসএস হল ঔরঙ্গজেবের মতো— মোগল বাদশা যেমন সবাইকে মুসলমানে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, আরএসএস সবাইকে হিন্দু বানিয়ে ফেলতে চায়। পঞ্জাবে আরএসএস-এর শাখা সংগঠন ‘রাষ্ট্রীয় শিখ সঙ্গত’ হিন্দু মন্দিরে গ্রন্থসাহিব পাঠের আয়োজন করতে চেয়েছে, নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অকাল তখত। ২০০৪ সালে গ্রন্থসাহিব রচনার চারশো বছর পূর্তি উপলক্ষে মিছিল বার করতে চেয়েছে সঙ্গত, অকাল তখত থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে যে, আরএসএস-এর এই শাখা সংগঠন শিখদের পথভ্রষ্ট করতে চায়, তাদের সঙ্গে যেন কোনও শিখ সহযোগিতা না করেন। সাম্প্রতিকতম ধাক্কাটি খেয়েছেন মোহন ভাগবত। গত বছর অমৃতসরে তিনি ফের ঘোষণা করেছিলেন, ভারত একটি হিন্দুরাষ্ট্র, এবং ভারতীয়মাত্রেই হিন্দু। অকাল তখতের প্রধান বিবৃতি দিলেন, আরএসএস-প্রধানের মন্তব্যটি দেশে নতুন বিভাজন তৈরি করবে, এবং তাতে দেশের স্বার্থই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন বারে বারে ধাক্কা খেয়েছে অকাল তখতের দোরগোড়ায়। এবং, শিখ জনগোষ্ঠীতে তখতের প্রভাব প্রশ্নাতীত। এখানেই উল্লেখ করে রাখা যাক, সেপ্টেম্বরে কৃষি আইন তৈরি হওয়ার পরই অকাল তখতের প্রধান জ্ঞানী হরপ্রীত সিংহ বিবৃতি দিয়ে তার বিরোধিতা করেছিলেন, আইন প্রত্যাহার করার কথা বলেছিলেন।
প্রশ্ন উঠবে, বিজেপি কী ভাবে এত দিন পঞ্জাবে ক্ষমতায় থাকল? এ প্রশ্নের উত্তর ছিল প্রকাশ সিংহ বাদলের কাছে। শিখ ধর্মের যাবতীয় মুখ্য প্রতিষ্ঠানের উপর অকালি নেতার নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রবল। এতটাই যে, বিজেপির সঙ্গে জোটেও শিখ ভোট পেতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। অন্তত, কিছু দিন আগে পর্যন্ত। সংখ্যালঘু হিন্দু ভোট টানত বিজেপি— বিশেষত শহরাঞ্চলে। অকালি দলের সেই নিশ্চিত ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরল ২০১৫ সালের পর থেকে। অভিযোগ উঠল, তিনি শিখদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে ব্যবহার করছেন নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ২০১৯-এর ভোটে স্পষ্ট, অকালি দল তাদের শিখ সমর্থনভিত্তি হারিয়েছে। জয়ী হলেন যে দু’জন মাত্র সাংসদ— বাদলের পুত্র সুখবীর এবং পুত্রবধূ হরসিমরত— তাঁদের ঝুলিতে ভোট দিয়েছিলেন মূলত হিন্দুরা।
ধর্মীয় ভাবাবেগকে ব্যবহার করে রাজনীতি তো নতুন নয়। তা হলে, হঠাৎ ২০১৫-র পর থেকেই প্রকাশ সিংহ বাদলের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠল কেন? তার প্রত্যক্ষ কারণ ছিল বারগারিতে গ্রন্থসাহিবের অবমাননা, এবং বিজেপি-ঘনিষ্ঠ অপরাধীদের মুখ্যমন্ত্রী আড়াল করছেন, এই অভিযোগ। কিন্তু, তার চেয়েও বড় কারণ হল, মোদী-শাহ জুটির চাপের সামনে বাদলের ক্রমশ গুটিয়ে যাওয়া, ক্রমশ তাঁদের ক্রীড়নকে পরিণত হওয়া দেখে আশঙ্কিত হয়েছেন শিখরা। এর আগে অবধি যতই বিজেপির সঙ্গে জোট হোক, পঞ্জাবে শেষ কথা বলার অধিকার ছিল বাদলের হাতে— তিনি শিখ-স্বার্থ রক্ষা করবেন, এই বিশ্বাস ছিল। মোদী-শাহ জুটি বুলডোজ়ার চালিয়ে দিয়েছেন সেই ক্ষমতার ভারসাম্যের উপর। চালাতে চেয়েছেন হিন্দুত্বের রথ। আর, এত দিন অবধি আরএসএস-তখত বিরোধের মধ্যে যে পাঁচিলটা ছিল, সেই প্রকাশ সিংহ বাদল কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন। পঞ্জাবে এখন শিখ-স্বার্থ বনাম হিন্দুত্ববাদের সংঘাত।
মোদী-শাহ জুটির প্রধানতম ভুল— স্বভাবজাত গা-জোয়ারির ফলে প্রায় শতাব্দী-প্রাচীন একটা অস্বস্তিকে প্রত্যক্ষ সংঘাতে পরিণত করা। ক্ষুদ্র, বিভেদমূলক রাজনীতির কৌশলে তাঁদের পারদর্শিতা প্রবাদপ্রতিম। পঞ্জাবকেও তাঁরা সামলে নিতে পারবেন না, এমন কথা বলারও কোনও প্রশ্ন নেই। কিন্তু, এটাও সত্য যে পঞ্জাবে কৃষি, ধর্ম আর রাজনীতির সমীকরণ তাঁরা ধরতে পারেননি। বোঝেননি, তাঁদের বাড়িয়ে তোলা অবিশ্বাসের পটভূমিকায় গায়ের জোরে কৃষির সম্পর্ক বদলে দিতে চাইলে কী বিস্ফোরণ হতে পারে।
তাঁরা তো রামায়ণ পড়েছেন। অতি দর্পে কী বিপদ হয়, নিশ্চয়ই জানেন।