Coronavirus

প্রহসন

কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজটিও আর এক দফা রসিকতা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২০ ০০:৫৫
Share:

প্রধানমন্ত্রী হয়তো রসিকতাই করিলেন। একটানা আধ ঘণ্টা আত্মনির্ভরশীল বা লোকাল-ভোকাল ইত্যাদি বলিয়া যাওয়া হয়তো উচ্চমার্গের রসিকতা। তবে, ঊনপঞ্চাশ দিনের লকডাউনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক যখন ধ্বস্ত, রেললাইনে-হাইওয়ের ধারে যখন পড়িয়া থাকিতেছে ঘরে ফিরিতে ব্যর্থ হওয়া অভিবাসী শ্রমিকের লাশ, বেকারত্বের হার সর্বকালের সব রেকর্ড ভাঙিয়া দিয়াছে— রসিকতা করিবার জন্য সেই সময়টিকে এবং সেই পরিস্থিতিটিকে বাছিয়া লইবার মধ্যে সুবিবেচনা নাই, অবিশ্বাস্য নির্মমতা আছে। দেশের সিংহভাগ মানুষের যেখানে অন্নের নিশ্চয়তা নাই, সেখানে কিসের আত্মনির্ভরতা? কিসের বিশ্বশক্তি হইয়া উঠা? ছয় বৎসর হইয়া গেল তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হইয়াছেন; ‘দেশ’ কাহাকে বলে, এত দিনেও কি তিনি তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না? আত্মশক্তিতে ভর দিয়া বিশ্বসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটি লইবার জন্য তিনি পাঁচ দফা ঔষধ বাতলাইয়াছেন। তাহার মধ্যে পরিকাঠামো আছে, প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা রদ করিবার কথা আছে, তরুণদের গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে, চাহিদা ও জোগান বাড়াইবার কথাও আছে। আর্থিক বৃদ্ধির জন্য কাজগুলি করা বিধেয়, সন্দেহ নাই— কিন্তু, ইহা জ্বর হইলে প্যারাসিটামল সেবনের পরামর্শের ন্যায়, সকলেরই জানা। এই অতিমারি-দীর্ণ সময়ে দেশের জন্য প্রধানমন্ত্রী কী ভাবিলেন, আধ ঘণ্টার প্রহসনে তাহা জানা গেল না।

Advertisement

কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজটিও আর এক দফা রসিকতা। এই জমানায় সরকারি প্যাকেজমাত্রেই তিন ভাগ জল— সে ইনফ্রাস্ট্রাকচার পাইপলাইনই হউক বা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ত্রাণ। হিসাবের সেই ছলচাতুরির কথা বাদ রাখিলেও স্পষ্ট, ‘দেশ’ নামক বস্তুটির প্রকৃত রূপ প্রধানমন্ত্রীর চোখে ধরা দেয় না। নচেৎ এই টাকা বরাদ্দ হইত এমন ভাবে, যাহার প্রধান উদ্দেশ্য হইত সাধারণ মানুষের হাতে টাকা পৌঁছাইয়া দেওয়া। তাহার জন্য ন্যূনতম সর্বজনীন আয়ের ব্যবস্থা করা যাইত, কর্মসংস্থান যোজনায় বরাদ্দ বাড়ানো যাইত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। এই সুযোগে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতিসাধন করা যাইত; অন্তত এই অর্থবর্ষে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের পরিমাণ জিডিপি-র এক শতাংশের কলঙ্কময় গণ্ডি টপকাইতে পারিত। শিক্ষায় ব্যয়বৃদ্ধি করা চলিত। মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বাড়াইলে শিশুদের পুষ্টির ব্যবস্থাও যেমন হইত, তেমনই অর্থব্যবস্থায় টাকার জোগানও দেওয়া যাইত। কেন্‌সীয় ব্যবস্থাপত্রকে সাধারণ মানুষের সর্বাধিক উপকারের কথা মাথায় রাখিয়া প্রয়োগ করিবার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মুখে একমাত্র বাধা ছিল তাহাদের কল্পনাশক্তি। দেখা গেল, বাধাটি অলঙ্ঘ্য।

আর্থিক প্যাকেজ, তাহা যত মহার্ঘই হউক না কেন, ঘোষণা করিবার জন্য অর্থমন্ত্রীই যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রীর নিকট জানিবার ছিল, এই দুর্বিপাকে তিনি কাহার পক্ষে আছেন। যাহা জানা গেল, তাহা এই রূপ— তিনি দরিদ্র, লাঞ্ছিত, বিধ্বস্ত ভারতবাসীর পার্শ্বে নাই। তাঁহার বক্তৃতায় অভিবাসী শ্রমিকদের কথা আসিয়াছে প্রসঙ্গক্রমে। কাজ হারানো কোটি কোটি মানুষ সেটুকু গুরুত্বও পান নাই। তবে, তাঁহার এই অবজ্ঞার মধ্যে যে এক গোত্রের সমদর্শিতা আছে, তাহাও অনস্বীকার্য। কয়েক মাস পূর্বেও তিনি টুপি-দাড়ি দেখিয়া লোক বিচার করিতেন। তাঁহার আজিকার অবজ্ঞায় সেই ভেদাভেদ নাই। যে অভিবাসী শ্রমিকরা ঘরে ফিরিতে মরিয়া, ধর্মীয় পরিচয় দিয়া তাঁহাদের আলাদা করিয়া দেখিবার কোনও উপায় নাই। দারিদ্র তাঁহাদের পরিচিতি নির্মাণ করিয়াছে। তাঁহাদের কে কিসের মাংস ভক্ষণ করেন, আর কে বিনা প্রশ্নে নাগরিকপঞ্জির চৌকাঠ পার করিতে পারিবেন, ক্ষুধা বা অসহায়ত্ব যেমন সেই ভেদ করে নাই, তাঁহাদের অবহেলা করিবার ক্ষেত্রেও সেই ভেদবিচার হয় নাই। ক্ষুধার জ্বালায় সবাই সমান ক্লিষ্ট, এবং ক্ষুধার্ত সাধারণ মানুষ সকলেই এখন দেশের নেতৃত্বের অবিবেচনায় বিপদগ্রস্ত।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement