ডাক্তার পেটানোয় আমাদের রাজ্যের জুড়ি মেলা ভার

জানতে ইচ্ছে করে যাঁরা ডাক্তার পেটান তাঁরা কি নিশ্চিত যে, ভবিষ্যতে আর কোনও দিন তাঁরা অসুস্থ হবেন না? তাঁদের আর চিকিৎসকের প্রয়োজন পড়বে না? লিখছেন সুদীপ ভট্টাচার্যবড্ড জানতে ইচ্ছে করে যাঁরা ডাক্তার পেটান তাঁরা কি নিশ্চিত যে, ভবিষ্যতে আর কোনও দিন তাঁরা অসুস্থ হবেন না?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৯ ০২:৪৮
Share:

ধরে নিচ্ছি ডাক্তার পেটানো একটা মহৎ সামাজিক কাজ। কিন্তু ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে, ডাক্তার পেটাতে গিয়ে যদি কারও হঠাৎ হার্ট অ্যাট্যাক হত বা অসুস্থ হয়ে পড়তেন কোনও কারণে, তখন ওই মারকুটেরা কি তাঁদের কৌলিন্য বজায় রাখতেন?

Advertisement

ওই অসুস্থকে নিশ্চয় পাষণ্ড বর্বর ডাক্তারদের কাছে নিয়ে না গিয়ে ফিরিয়ে আনতেন বাড়ি। না কি পেটানো ভুলে ডাক্তারকে বলতেন, ‘‘কিছু একটা করুন। দেরি হলে আর বাঁচাতে পারব না!’’

বড্ড জানতে ইচ্ছে করে যাঁরা ডাক্তার পেটান তাঁরা কি নিশ্চিত যে, ভবিষ্যতে আর কোনও দিন তাঁরা অসুস্থ হবেন না? কোনও দিন আসতে হবে না হাসপাতালে? না কি ভাবেন, ‘‘আজ তো পিটিয়ে নিই। পরের বার আমায় দেখে চিনতে পারবে থোড়াই?’’ তখন বলব, ‘‘ডাক্তারবাবু আপনিই তো আমাদের বাপ-মা, দয়া করে মেয়েটাকে বাঁচান ডাক্তার।’’

Advertisement

আর ডাক্তার বিগলিত হয়ে গত দিনের কথা ভুলে গিয়ে রোগীর সেবা করবেন।

ডাক্তার কিন্তু মনে রাখেন না। তাঁকে বাপ-মা বলুন আর নাই বলুন তাঁর ধর্ম সেবা। তা তিনি পালন করেন। মনে রাখলে চিকিৎসাটাই আর কোনও দিন পাওয়া যেত না। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। এই কিছু দিন আগে সদর হাসপাতালে প্রসব করাতে এসে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। প্রসূতির অবস্থা খুব খারাপ ছিল, এমনই দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু রোগীর পরিবারের অভিযোগের তির কর্তব্যরত নার্স আর ডাক্তারের দিকে ছিল। কর্তব্যে গাফিলতির কারণে প্রসূতি মৃত্যুর অভিযোগ। হাজির সাংবাদিক। পরিস্থিতি সামাল দিতে দাঁড়িয়ে পুলিশ গাড়িও। লোক জমতে থাকে। ক্ষোভ বাড়তে থাকে। হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে কোনও এক জন বলে ওঠেন— হাসপাতাল ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেওয়া দরকার।

এটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল। সবাই ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ’ করে ওঠে। যাঁদের চোখ ভাঙচুরের ভাবনায় জ্বলে ওঠে তাঁদের অনেকেরই মা, বোন, বা দিদি সদ্যোজাত সহ ভর্তি তখন হাসপাতালে। সে কথা কিন্তু তখন তাঁদের মনে নেই। ভাঙলে কি ক্ষতি হতে পারে? ভিতরে থাকা মা-শিশুদের কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে, তা-ও খেয়াল নেই তখন তাঁদের।

আসল কথা হল মদত, উস্কানি। যাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছে বা যাঁর কন্যা মারা গিয়েছে তাঁর মনের সেই মুহূর্তের পরিস্থিতিতে সাময়িক ভাবে একটা ধ্বংসের ভাবনা আসা ক্ষমা করা যায়। কিন্তু তখন কী করা উচিত বাকিদের? তাঁকে বোঝানো উচিত? না কি তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ভেঙে চুরমার করে দেওয়া উচিত? ডাক্তার, নার্স সবাইকে উত্তমমধ্যম দিয়ে উচিত শিক্ষা দেওয়া উচিত?

না, সে দিন শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটেনি। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মী, সাংবাদিক আর দু’ এক জন তাঁদের বোঝাতে পেরেছিলেন ভাঙচুরের ফলে ক্ষতি বেশি, না লাভ? ভাঙচুরে ভিতরে থাকা কত রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। বন্ধ হতে পারে চিকিৎসা পরিষেবা। তাতে আসলে কাদের ক্ষতি? কাদের লাভ এই সব করে? তাঁদের পাশে সে দিন মদত দেওয়ার মতো কোনও গুপ্তশক্তি ছিল না। রাজনৈতিক ফায়দা তুলতেও আসেনি কোনও রাজনৈতিক দল, তাই হয়তো শেষ পর্যন্ত মানুষকে বোঝানো গিয়েছিল সে দিন। তাই ক্ষোভের আগুন নিভতে সময়ও বেশি লাগেনি।

তবে এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চিত্র সাংবাদিকতা করার সূত্রে এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি বহু বার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি ইচ্ছে করলেই বোঝানো যায় শোকাহত পরিবারকে, কিন্তু সেটা করা হয় না। তার বদলে উস্কানি দেওয়া হয়। হ্যাঁ, চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতেই পারে, অভিযোগ থাকতে পারে চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও। অভিযোগ থাকতে পারে রোগী মৃত্যুর কারণ নিয়ে। কিন্ত তার জন্য আইন আছে। আদালত আছে। সেখানে বিচার হবে— কে ঠিক, কে ভুল।

ভাঙচুর করে, ডাক্তার পিটিয়ে কি এর সমাধান হয়?

আসলে অনেকে মজা পান এমন করে। অনেকে তো জানেনই না, কেন ডাক্তারদের পেটাচ্ছেন। কেন ভাঙচুর, হামলা করছেন। সবাই ভাঙছে তাই ভাঙছি, মেরে নিচ্ছি, ইট ছুড়ছি! দারুণ মজা! কোথায় নেমেছি আমরা? ভাবতে অবাক লাগে! অবশ্য অবাক হওয়ারও কিছু নেই। এটাই তো এখন স্বাভাবিক। সারা রাজ্য জুড়েই তো চলছে ধ্বংসের রাজনীতি। কারও কি এক বারও হাত কাঁপে না যে চিকিৎসক, নার্স মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকেন, তাঁদের আক্রমণ করতে! হয়তো খানিক আগেই তাঁরই পরিচিত কোনও রোগীর চিকিৎসা করেছেন যে ডাক্তার, তাঁর গায়েই হাত তুলতে?

আর প্রতিটা ঘটনার পরেই অবধারিত ভাবে একটা বিষয় উঠে আসে। প্রশ্ন ওঠে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া নিয়ে। নিরাপত্তা দিতে অক্ষম পুলিশ, তাই এই ভাঙচুর, বারবার চিকিৎসক নিগ্রহ। তার পরেও চিকিৎসকদের নিরাপত্তা দেওয়া নিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তা করা হচ্ছে না কেন? নিশ্চিন্তে চিকিৎসা করার মতো পরিবেশ আর মানসিক স্থিতি না থাকলে কী ভাবে রোগীদের উপযুক্ত পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হবে?

প্রশ্ন আরও আছে। সরকারি হাসপাতাল তো সকলের জন্য। মানুষের বাঁচার জন্য। এখানে এমন ঘটনা ঘটলে তা আমাদের সকলের লজ্জা। এখানে পুলিশের প্রয়োজন হবে কেন এমন ঘটনা ঠেকানোর জন্য? কেন অন্য রোগীর পরিজন, স্থানীয় মানুষ সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করবেন না? কেন ডাক্তারদের মারধর করা হলে বাকিরা এগিয়ে এসে বাধা দেবেন না?

অবশ্য প্রতিবাদ এখনও হয় অনেক সময়েই। আর হয় বলেই দেশটা এখনও নরক হয়ে যায়নি। চিকিৎসকদের পাশে সাধারণ মানুষ আছেন বলেই এই ঘটনা নিয়ে এত আলোচনা। এত তোলপাড়। সেই জনচেতনার ঢেউ যেন আগামী দিনেও ডাক্তারের গায়ে হাত তোলার আগে হুজ্জুতির ভিড়কে সরিয়ে দিতে পারে, সেই আশাই করব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement