ভ্রান্ত গবেষণার অতিমারি
PhD

চটজলদি গবেষণাপত্র ছাপানোর প্রবণতা মস্ত বিপদ ডাকছে

জীবনে কখনও ইন্টারনেট  ব্যবহার না করা হিগ্স সত্যি এই মার্কিন ‘পাবলিশ অর পেরিশ’ সংস্কৃতিতে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরিটি টিকিয়ে রাখতে পারতেন কি না, সন্দেহ।

Advertisement

স্বাগতম দাস

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share:

হিগ্স বোসন বা ‘ঈশ্বর-কণা’ বলে অনেক বেশি পরিচিত পদার্থের এক আদি কণার অন্যতম আবিষ্কারক এবং ২০১৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলবিজেতা পিটার হিগ্স এক বার খেদোক্তি করেছিলেন যে আজকের যুগ হলে তাঁকে আর অধ্যাপনা করে খেতে হত না! কারণ তাঁর গোটা গবেষণা জীবনে তিনি সাকুল্যে দশটিরও কম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বা ‘পেপার’ লিখেছিলেন।

Advertisement

জীবনে কখনও ইন্টারনেট ব্যবহার না করা হিগ্স সত্যি এই মার্কিন ‘পাবলিশ অর পেরিশ’ সংস্কৃতিতে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরিটি টিকিয়ে রাখতে পারতেন কি না, সন্দেহ। গত শতাব্দীর মোটামুটি সত্তরের দশক থেকে সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞান-সহ অন্যান্য যে কোনও গবেষণামূলক বিষয়ে ব্যক্তিবিশেষের উৎকর্ষের মানদণ্ড আর সেই বিষয়ের অতলান্ত পাণ্ডিত্যের ওপর নির্ভরশীল রইল না, হয়ে উঠল নিছকই কিছু সংখ্যা। বছরে কত পাতা পেপার লেখা হচ্ছে, সেই সব প্রবন্ধ অন্য বিজ্ঞানীদের কাজে কত বার উল্লিখিত হচ্ছে— এই সব নানান সংখ্যা। ফলে অনেক তরুণ গবেষক বিজ্ঞানসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর গভীরে গিয়ে সমাধান খোঁজার বদলে, অল্প সময়ে কী করে প্রচুর পেপার ছাপানো যায়, সেই শিল্পটি রপ্ত করতে ব্যস্ত হয় পড়লেন। এর সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হল ফান্ডিং বা গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান পেতে বাজারচলতি বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করার বাধ্যবাধকতা।

পেপার লিখে যে কোনও ফলাফল প্রকাশ করার আগে, বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে যাচাই করে নেওয়া এবং সেই ফলাফলের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটা বিজ্ঞানচর্চার একদম গোড়ার কথা। কিন্তু তা বললে চলবে কেন? এই ভাবে যাচাই করে নিতে গেলে যে প্রচুর সময় লাগে। এতটা সময় দিতে হলে ফস্কে যেতে পারে পদোন্নতি, ফান্ডিং, খ্যাতি, পুরস্কার— কত কিছু। সেই জন্যেই সম্ভবত, বাথরুম-সিঙ্গারদের হঠাৎ গানের অ্যালবাম বার করে ফেলার মতো, বিজ্ঞান-গবেষকদের একটা বড় অংশের মধ্যে চটজলদি কিছু একটা করার এত প্রচেষ্টা। এর তুঙ্গ পর্যায়টি দেখা গেল এই করোনা-কবলিত সময়ে, যখন সংক্রমণ সংক্রান্ত প্রতিটি কথা বলা দরকার খুব মেপে, অনেক হিসেবে কষে।

Advertisement

এ বছরের গোড়া থেকেই কোভিড-১৯ অতিমারির বিষয়ে রাশি রাশি প্রবন্ধে প্রায় উপচে পড়ছে বিভিন্ন ডিজিটাল আর্কাইভগুলো। এই অনলাইন পোর্টালগুলোর একটা দারুণ সুবিধে হল প্রচুর গ্রাফ, টেবিল, নকশা সমন্বিত একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধকে যে কোনও সময় বিনা বাধায় এখানে তুলে দিয়ে বিজ্ঞানজগতের নজরে আনা চলে। তার জন্য পিয়ার রিভিউ অর্থাৎ সমসাময়িক বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সংশোধনের অগ্নিপরীক্ষাটি দেওয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু গবেষণালব্ধ ফলকে অতি দ্রুত কাজে লাগাতে সময় সংক্ষেপণের উক্ত প্রক্রিয়া যতই সাধু উদ্দেশ্যে সৃষ্ট হয়ে থাক, পৃথিবীজোড়া অতিমারির এই দিশাহারা সময়টা তার পক্ষে হয়ে গিয়েছে একদম ভুলভাল। ফলে তাড়াহুড়ো করে লেখা এবং পরস্পরবিরোধী দাবিতে ঠাসা এই সব প্রবন্ধের ফলাফল সমাজমাধ্যম ও গণমাধ্যমের হাতে পড়ে আরও পল্লবিত মিথ্যার রূপ নিয়ে মানুষকে ভয়ানক বিভ্রান্ত করে তুলেছে। আবার শুধু আর্কাইভসই নয়, ভুয়ো তথ্য ও অনির্ভরযোগ্য পরীক্ষার ভিত্তিতে লিখিত এই ধরনের পেপারের ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা পায়নি দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন বা দ্য ল্যানসেট-এর মতো প্রথম সারির মেডিক্যাল জার্নালগুলিও। ভুল ধরা পড়ার পর সেই প্রবন্ধগুলিকে প্রত্যাহার করার মাধ্যমে জার্নালগুলোকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে।

কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ‘গবেষণা’য় আন্তর্জাতিক স্তরে সৃষ্টি হওয়া বিভ্রান্তির দুটো মোক্ষম উদাহরণ দেওয়া যাক। গত মার্চের ১১ তারিখে, দ্য ল্যানসেট রেসপিরেটরি মেডিসিন জার্নাল-এ একটি ছোট্ট প্রবন্ধ ছাপিয়ে এক দল ইউরোপীয় বিজ্ঞানী দাবি করেন, কোভিড-আক্রান্তদের পক্ষে প্রদাহ কমাতে বহুলপ্রচলিত আইবুপ্রোফেন ওষুধটি মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। এই দাবির নেপথ্যে কোনও নিশ্ছিদ্র বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা না থাকলেও, প্রবন্ধটি প্রকাশের তিন দিন পরেই ফ্রান্সের স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে করোনা সংক্রান্ত জ্বরে আইবুপ্রোফেন ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। একই মর্মে সাবধানবাণী টুইট করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। সমাজমাধ্যমেও যথারীতি আইবুপ্রোফেন ব্যবহার করে করোনা আক্রান্তদের মর্মান্তিক পরিণতির নানা কল্পগল্প ভেসে বেড়াতে থাকে। এর কিছু দিন পরে, পূর্বোক্ত প্রবন্ধের দুর্বলতাগুলো ধরিয়ে দিয়ে অন্য একটি গবেষকদল আর একটি প্রবন্ধ ছাপিয়ে স্পষ্ট করে দেন যে করোনা সংক্রমণে আইবুপ্রোফেন-এর তথাকথিত মারাত্মক প্রভাবের কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সে ভাবে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকাও পাল্টায়।

একই ভাবে মার্চের ২০ তারিখে আর একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে ফ্রান্সের এক দল বিজ্ঞানী দাবি করেন, শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এমন করোনা-সংক্রমিতদের ক্ষেত্রে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন এক অব্যর্থ ভূমিকা নিতে পারে। অপর্যাপ্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ভিত্তিতে লেখা এই পেপারটি করোনার আক্রমণে মোটামুটি দিশাহারা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কী প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল, ভাবলে অবাক হতে হয়। এপ্রিলের গোড়ার দিকে ভারতেও বার বার শোনা গিয়েছিল যে বেঙ্গল কেমিক্যাল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন-এর যথেষ্ট উৎপাদন শুরু করলেই করোনার দিন মোটামুটি শেষ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে, বেশ কিছু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরেও ফুসফুসে কোভিড-জনিত ক্ষতি আটকাতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন-এর তথাকথিত ভূমিকা সম্বন্ধে নিঃসংশয় হতে পারেননি বহু গবেষক।

গত কয়েক মাসে এই সব বিভ্রান্তির পরিণতি খুবই করুণ। কখনও শোনা গিয়েছে নুন-জলে কুলকুচি করলে করোনাভাইরাস গলাতেই মারা পড়বে; কখনও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে কী ধরনের মাস্ক ব্যবহার করা উচিত তা-ই নিয়ে; আবার কখনও সরকারি উদ্যোগে মানুষ প্ররোচিত হয়েছেন হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ কিনতে— কার্যকারিতার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও।

ভুল তথ্যের প্রতিযোগিতায় জীববিজ্ঞানীদের চেয়ে পিছিয়ে নেই ফলিত গণিতজ্ঞ, রাশিবিজ্ঞানী, তথ্যবিজ্ঞানীরাও। মনে করে দেখা যেতে পারে, গত তিন-চার মাসে কত বার এপ্রিল-মে-জুনের কোন সময় সংক্রমণের গ্রাফ আকাশ ছোঁবে, কখন সমতলে নেমে আসবে, এই সব অলীক দাবি বিজ্ঞানের অন্দরমহল থেকে সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছে। বিজ্ঞান গবেষকদেরই যদি অবস্থা এমন হয়, তা হলে রুটি-রুজির তাগিদে নাজেহাল আমজনতা কলকাতার ময়দানে করোনাদেবীর পুজোতে শামিল হলে তেমন দোষ দেওয়া যায় কি?

সম্প্রতি অতিমারির গবেষণায় এই বিপজ্জনক প্রবণতা নিয়ে বিজ্ঞানের জগতের অন্যতম সেরা পত্রিকা সায়েন্স-এর মে সংখ্যাতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে আমাদের সতর্ক করেছেন কার্নেগি-মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের এথিক্স-এর অধ্যাপক আলেক্স লন্ডন। লিখেছেন, আমরা এমন একটা দুঃসময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা এমনই তারে বাঁধা রয়েছে, যেখানে অপ্রতুল তথ্য ও পরিকাঠামো নিয়ে কিছু ভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার বদলে আদৌ কোনও গবেষণা না করাই ভাল; ভুল কথা বলার চেয়ে চুপ করে থাকাটাই কল্যাণকর। অর্ধসিদ্ধ গবেষণার ফল যাতে নিমেষে ভাইরাল হয়ে গিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও উদ্বেগ না বাড়ায়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রাথমিক ভাবে বিজ্ঞানীদেরই। আজকের দিনে, করোনাভাইরাসের চেয়ে সম্ভবত বেশি ক্ষতিকর হয়ে উঠছে সেই ভাইরাস সংক্রান্ত অমূলক ভীতি। সেই ভীতিকে উস্কে, আসল অতিমারির পাশাপাশি চলছে ‘ইনফোডেমিক’— ভুল তথ্যের মহামারি। বিশ্বজোড়া চাপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, রাজনীতির কারবারিদের চোখরাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে এই ইনফোডেমিক রুখে দেওয়ার দায়ও বর্তায় বিজ্ঞানীদের ওপরেই।

আশার কথা, গবেষকদের একটা বড় অংশ নিঃশব্দে কাজ করে চলেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মানুষকে করোনা এড়াতে স্যানিটাইজ়ার ইনজেকশন নেওয়ার নিদান দিয়েও এই বিজ্ঞানীদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে পরের দিনই ঢোক গিলে বক্তব্য পাল্টাতে বাধ্য হন। এঁরা সেই বিজ্ঞানী, যাঁরা রাষ্ট্রচালকদের ইঙ্গিত অগ্রাহ্য করে মানুষকে বুঝিয়ে দেন, কোভিড-১৯’এর প্রতিষেধক টিকা হঠাৎ জাদুবলে কোনও পবিত্র দিন বা তিথিতে তৈরি হয়ে যাবে না, তার জন্যে প্রয়োজন হবে অতিসাবধানী গবেষণা এবং দীর্ঘমেয়াদি হিউম্যান ট্রায়াল। এঁদের নিরলস এবং নৈর্ব্যক্তিক কাজই অনিশ্চয়তার কালো মেঘের মধ্যে একমাত্র রুপোলি রেখা।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা। মতামত ব্যক্তিগত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement