আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হিন্দুধর্মের এ কোন পরিত্রাতার মূর্তি প্রত্যক্ষ করছে দেশ?
এ কোথায় চলেছে ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্নে বিভোর ভারত? স্মরণে এল রবীন্দ্রনাথের ‘মানবপুত্র’ কবিতাটি। কবিতায় কবি কল্পনা করেছেন ক্রুশকাঠে প্রাণবলি দেওয়া যিশুখ্রিস্ট আজ যদি পৃথিবীতে নেমে আসেন, তা হলে বুঝবেন তাঁর আত্মদান সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। কবিকল্পনায় মানবপুত্র এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে বুকে হাত চেপে ধরলেন। যন্ত্রণায় ঊর্ধ্বে চেয়ে বলে উঠলেন— ‘হে ঈশ্বর, হে মানুষের ঈশ্বর, কেন আমাকে ত্যাগ করলেন?’
৩০ জানুয়ারি ছিল জাতির জনকের আত্মাহুতি দিবস। সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া নানা দৃশ্য দেখে হয়তো তিনিও তাঁর নিধনকালীন শব্দ দু’টিই পুনর্বার উচ্চারণ করতেন— ‘হে রাম’। মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেওয়া, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হিন্দুধর্মের এ কোন পরিত্রাতার মূর্তি প্রত্যক্ষ করছে দেশ? এই যে সনাতন ‘হিন্দুধর্ম, হিন্দুধর্ম’ বলে জিগির শোনা যাচ্ছে চারদিকে, যে ‘সনাতনী’ চিল চিৎকারে কানপাতা দায় তা আসলে একটা জগাখিচুড়ি শব্দ। হিন্দুধর্মকেই তো সনাতন ধর্ম বলা হয়। সনাতন শব্দের অর্থ শাশ্বত বা চিরন্তন। এই ধর্ম অনুশীলনকারীদের বিশ্বাস যে এই ধর্ম আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। হিন্দুধর্ম জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যুগ যুগ ধরে সংখ্যাহীন মুনিঋষির সুগভীর প্রজ্ঞা, ধ্যান-অনুধ্যানের সঞ্চয়। কয়েক হাজার বছর ধরে জীবনস্রোতের বহমানতা। ইংরেজিতে যাকে বলে, a whole world of meaning, তা আছে শব্দটিতে। সামগ্রিকতাকে বাদ দিয়ে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ অর্থে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এখন ব্যবহার হচ্ছে শব্দটি।
রামায়ণের রাম চরিত্রের অন্যতম প্রধান গুণ হল তাঁর সহিষ্ণুতা। যা সাহিত্যের পরিভাষায় ট্র্যাজিক নায়ক চরিত্রের hamartia or fatal flaw. আর এই সহনশীলতার জন্যই তিনি জীবনের সব কিছু পেয়েও সব হারানো এক মহাকাব্যিক নায়ক। হাজার হাজার বছরের প্রাচীন এই ভারতীয় সভ্যতা হিন্দুধর্মের ধারক ও বাহক। তার জন্য ‘সনাতন’ প্রভৃতি বিশেষণ বা ঢক্কানিনাদের কোনও প্রয়োজন নেই। দেশে-বিদেশে সব পণ্ডিত ব্যক্তি নতমস্তকে মেনে নিয়েছেন যে ভারতীয় শাস্ত্ররাজি মানুষের মনন-মনীষার এক অনবদ্য ফসল। এগুলির উপর সমগ্র মানবজাতির অধিকার, কোনও একটি সম্প্রদায়ের নয়। আর হিন্দুধর্মও তো কোনও গোষ্ঠীবিশেষের একান্ত আপনার ধন নয়। বহতা যে কোনও বৃহৎ নদীর মতোই তা চলমান একটি দেশ ও জাতির (যার মূল সুর বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, unity in diversity) জীবনচর্চা ও চর্যার পরিশীলিত বহিঃপ্রকাশ। কালে কালে নানা মানুষের ধারা এসে একে মহামানবের সাগর বা মিলনতীর্থে পরিণত করেছে। না হলে কী করে বলবে সে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’?
আরও পড়ুন: দ্বেষের মোড়কে দেশপ্রেম চাষ
ভারতীয় শাস্ত্ররাজির মূল সুরটিই মহামিলনের। বিশ্বমানবকে একত্রিকরণের। ধ্বংসের নয়, বিনাশের নয়, বিচ্ছিন্নতার তো নয়ই। শুক্ল যজুর্বেদের সেই বিখ্যাত স্তোত্রগুলি, যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন রচনায় বারংবার উদ্ধৃত করেছেন— “পিতা নোহসি পিতা নো বোধ নমস্তেহস্তু মা মা হিংসীঃ। বিশ্বানি দেব সবিতর্দুরিতানি পরাসুব যদ্ভদ্রং তন্ন আসুব।” অথচ, আজ আমরা ধর্মের নামে দেখছি সর্বত্র উলটপুরাণ। কথায় কথায় দানবীয় আস্ফালন, হিংসা, বলপ্রয়োগ, অন্যস্বর রুদ্ধ করার ‘সঙ্ঘবদ্ধ’ পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। ইংরেজ লেখক জোনাথন সুইফট আক্ষেপ করেছিলেন— ‘‘we have enough religion to make us hate but not enough to make us love each and another.’’ সনাতন ধর্মের নামে আজ ভারত জুড়ে যেন হিটলার, মুসোলিনির দর্পিত পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাই পূজার বেদি রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পথে-ঘাটে শিক্ষামন্দিরে ভিন্ন স্বর স্তব্ধ করার আয়োজন চলছে। অথচ, জাতির জনক কত বার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন— ‘‘intolerance in itself a form of violence and an abstacle to the growth of a true democratic spirit.’’
• নীতিগুলি হিন্দু-রঙে রঞ্জিত করো আর সশস্ত্র করো হিন্দুরাজকে।
বিনায়ক দামোদর সাভারকর, হিন্দু মহাসভার নেতা
• সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকের সাম্প্রদায়িকতাকে অতি দ্রুত জাতীয়তাবাদ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী
ধর্মের বেশে মোহ এসে ধরলে কাজ হল শুধু মারা আর মরা। গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে সমস্যার নিষ্পত্তি হয় না। প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসাকে ওয়াইর্ল্ড জাস্টিস বলা হয়। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, শক্তিমদমত্ততা বা ধর্মমূঢ়দের ধর্মবিকার কখনই শেষ কথা বলেনি। মহাকাল সম্মার্জনী হাতে ‘বর্বরতার বিকার বিড়ম্বনা’, মানুষের প্রতি মানুষের নিক্ষিপ্ত ‘লজ্জা ও লাঞ্ছনা’ এক দিন ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেই।
লেখক নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং বঙ্গবিবুধ জননী সভার সম্পাদক