মশা দমনে ড্রোন ব্যবহারের ভাবনা।
চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য হয় না, মশা প্রতিরোধও নহে— পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দফতরকে কথাটি স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাউক। মশার জন্ম প্রতিরোধ করিবার চটজলদি উপায় নাই। তাহার জন্য পরিচ্ছন্নতার কয়েকটি মৌলিক ও পরিশ্রমসাধ্য শর্ত পূরণ করিতেই হইবে। যথা, রাস্তা ও জনস্থানে আবর্জনা দূর করিতে হইবে; নিকাশিকে সচল এবং খালবিলগুলি পরিষ্কার করিতে হইবে; যে সকল স্থানে জল জমিতে পারে, যথা নির্মীয়মাণ বা পরিত্যক্ত বাড়ি, সেগুলিকে জলশূন্য ও পরিচ্ছন্ন রাখিতে হইবে। এই সকল কর্তব্যের কোনওটিই অজানা নহে। কিন্তু কাজগুলি প্রতি বারই উপেক্ষিত হয়। অবশেষে ডেঙ্গি করাল রূপ ধরিলে তখন জাদুকরের টুপি হইতে খরগোশ বাহির করিবার মতো, মশা মারিবার নূতন নূতন কায়দা উপস্থিত করিয়া নাগরিককে তাক লাগাইতে চাহে সরকার। কখনও পুকুরে গাপ্পি মাছ ছাড়িবার প্রতিশ্রুতি, কখনও বাড়ি বাড়ি জলাধার পরিদর্শন করিবার পরিকল্পনা ঘোষিত হয়। এ বৎসর সেই চমকপ্রদ তালিকায় যুক্ত হইয়াছে ড্রোন। পরিত্যক্ত আবাসগুলিতে জল জমিয়াছে কি না, তাহার ছবি তুলিবে উড়ন্ত ড্রোন, তৎসহ কীটনাশকও ছড়াইবে। তাহাতে আপত্তি নাই, কিন্তু যুদ্ধের কয় আনা এই পথে লড়া সম্ভব হইবে? গবেষকরা সম্প্রতি দেখিয়াছেন, এক একটি বাতিল টায়ারের জলে চার হাজার মশক-কীট জন্মাইতে পারে। শহরে কত বাতিল টায়ার পড়িয়া রহিয়াছে, তাহাতে ডেঙ্গির মশা কত জন্মাইতে পারে, ভাবিলে শিহরিয়া উঠিতে হয়।
অতএব প্রশ্ন, যে কাজগুলির জন্য উচ্চপ্রযুক্তির প্রয়োজন নাই, কেবল পরিকল্পনা ও কর্মী প্রয়োজন, সেইগুলি সারিয়া ফেলিলে হয় না? বাতিল টায়ার সম্পর্কে গাড়ি বিক্রেতা, গাড়ি সারাইবার দোকান এবং গাড়ির মালিকদের কী কর্তব্য? তাহা না মানিলে শাস্তি কী? মালিকহীন টায়ার, ব্যাটারির খোল রাস্তায় মিলিলে পুরকর্মীরা কী করিবেন? এ বিষয়ে পুরসভার নির্দিষ্ট নির্দেশাবলি না থাকিলে পরিস্থিতি বদলাইবে না। আর একটি প্রশ্ন: মশা মারিবার যে সকল পদ্ধতি ব্যর্থ বলিয়া প্রমাণিত, এখনও কেন সেগুলি প্রয়োগ করিয়া সময় ও টাকার অপচয় হইতেছে? ব্লিচিং পাউডার যে মশা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে না, বরং বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করে; ‘ফগিং মেশিন’ দিয়া রাস্তায় কীটনাশক ছড়াইলে মানুষ অধিক বিপন্ন হয়— এই কথাগুলি জানিয়াও ব্লিচিং ছড়াইয়া, ধোঁয়ায় পথ অন্ধকার করিয়া পুরকর্তারা নিজেদের অকর্মণ্যতা আড়াল করিতে চাহেন কি?
রাজ্যবাসী কোন ‘অজানা’ জ্বরে মরিতেছে, এক দিন হয়তো জানা যাইবে। কিন্তু প্রশাসনের অসুখটি গভীর। বিবিধ সরকারি প্রকল্পের বিশেষ সুবিধা নাগরিকদের নিকট পৌঁছানো, এবং তাহার কৃতিত্বের প্রচারই এখন নেতা-আধিকারিকদের প্রধান কাজ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। তাঁহারা স্বাস্থ্যবিমার কার্ড পৌঁছাইতে যত আগ্রহী, রোগ নিবারণে ততটা নহে। পতঙ্গ-নিয়ন্ত্রণের দ্বারা রোগ-নিয়ন্ত্রণের শ্রমসাধ্য কাজে স্বাস্থ্য দফতর বা পুরসভার আগ্রহ নাই। বরং পরিসংখ্যান গোপন করিয়া, চিকিৎসকদের চোখ রাঙাইয়া সরকার নিজের ব্যর্থতা ঢাকিতে চায়। নেতারা জানেন, জমা জল শুকাইলেই মৃত্যু কমিবে, নূতন সঙ্কট আসিয়া পুরাতনকে চাপা দিবে, যত দিন না তাহার পুনরাবৃত্তি হয়। অতএব, ড্রোন উড়াইয়া লোকের চোখে চমক লাগাইতে পারিলেই আপাতত যথেষ্ট।