অতিমারি-প্রসঙ্গে সম্প্রতি শোনা যাইতেছে, পৃথিবী আর পূর্বাবস্থায় ফিরিবে না। নূতন পৃথিবী হইবে বিপন্নতর, অশান্ততর। প্রসঙ্গত, এই বিপন্নতর বিশ্বের সঙ্কটগুলি বহুবিধ, বহুব্যাপ্ত। ইহার মধ্যে একটি হইল, মূল্যবোধের সঙ্কটজনিত যৌন বিকৃতি। এই বিষম সঙ্কটের এক নিদর্শন দেখা গেল গত সপ্তাহের ‘বয়েজ় লকার রুম’ এবং তৎপরবর্তী বিভিন্ন তথ্য উন্মোচনে। জানা গেল, ইনস্টাগ্রাম, গুগল ড্রাইভ-এর মতো সামাজিক প্ল্যাটফর্ম-কে ব্যবহার করিয়া বিভিন্ন স্তরের পড়ুয়া কিশোর-তরুণরা সমবয়সী কিশোরী-তরুণীদের আপত্তিকর শারীরিক ছবি সম্মিলিত ভাবে উপভোগ করিবার নেশায় জর্জরিত, এমনকি সমাজবিরুদ্ধ অপরাধ কল্পনা করিতেও নিয়মিত অভ্যস্ত। এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুলছাত্ররাও এই বিকৃতির শিকার। দিল্লির ঘটনা হইতেই সঙ্কটটি সামনে আসিল, কিন্তু জানা গেল বিকারগ্রস্ত তরুণসমাজের সেই তালিকায় আছে এই শহরের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারাও।
দিল্লির ঘটনাটি সত্যই স্তব্ধ করিবার মতো। আইনের চোখে অপরাধ করিলেও সংঘটনকারীরা বয়সে এতই ছোট যে তাহাদের আইনমাফিক ‘অপরাধী’ বলিবার উপায় নাই। এত অল্প বয়সে যে মানসিক বিকারের শিকার হইতেছে ইহারা, তাহা হইতে নিষ্কৃতির পথ কী? পথ কি আদৌ আছে? করোনা-উত্তর পৃথিবীতে এই প্রশ্ন আরও ভয়াল হইয়া দাঁড়াইতেছে, কেননা ক্রমশই প্রযুক্তির উপর আমাদের সন্তানদের নির্ভরতা বাড়িতেছে। ভুলিলে চলিবে না, মূল্যবোধের অবক্ষয় নূতন বিষয় নহে, কিন্তু তাহা যে আজ মহামারির ন্যায় সমস্ত সমাজকে বিপন্ন করিতে বসিয়াছে, তাহার পিছনে প্রযুক্তির ভূমিকা সর্বাধিক। প্রযুক্তির হাত ধরিয়াই নানা ধরনের বিকার বয়স এবং আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সাম্প্রতিক করোনাসঙ্কট সেই প্রযুক্তিনির্ভরতাকে এক অভূতপূর্ব স্তরে পৌঁছাইয়া দিয়াছে। মূল্যবোধের সঙ্কটও কি তাহার পিছু পিছু অদৃষ্টপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছাইবার উপক্রম করিতেছে?
অ-প্রাপ্তবয়স্কই হউক আর সদ্যতরুণই হউক, এহেন অপরাধের একটি বিশেষত্ব সম্ভবত, তাহার গুরুত্ব ও বিধ্বংসী ক্ষমতা সম্পর্কে অপরাধকারীদের অধিকাংশেরই অসচেতনতা। তাহাদের অনেকের কাছেই ইহা নিছক মজা, ‘স্বাভাবিক’ পৌরুষ-উপযোগী বিনোদন। মজা ও অপরাধের মধ্যে রেখাটি যে কতই ক্ষীণ, ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া যাহাকে ভাবা হইতেছে তাহা যে কতই ‘অস্বাভাবিক’, তাহা বুঝাইবার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত দিক-নির্দেশের। কাহার কাজ সেই দিক-নির্দেশ? ইহা কি কেবল আইনের বিষয়? রাষ্ট্রের দায়িত্ব? না। এই দায়িত্ব প্রধানত সমাজের, পরিবারের, অভিভাবকের, পিতামাতার। এই দায়িত্ব ব্যক্তির। পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থ ও অসুস্থ ভাবনার পার্থক্যটি শিখাইবার কাজ তাঁহাদেরই। সন্তানের হাতে প্রযুক্তি তুলিয়া দিবার সঙ্গেই দায়িত্ব শেষ হইয়া যায় না। সেই প্রযুক্তি ঠিক ভাবে ব্যবহৃত হইতেছে, না কি সন্তানের বিপথে যাইবার পথটি প্রশস্ত করিতেছে, তাহার উপর নজর রাখিবার দায়িত্বও তাঁহাদেরই। ভারতে এখনও সাইবার অপরাধ আইন ধোঁয়াশামুক্ত নহে, ইহার প্রায়োগিক দিকটিও সীমাবদ্ধ। কিন্তু শুধুমাত্র আইন-বিচার দিয়া ব্যাপ্ত মূল্যবোধের বিকৃতিকে অবদমিত করা সম্ভব নয়। সেই অতি-জরুরি কাজের জন্য প্রতিটি পরিবারকে দায়িত্ব লইতে হইবে।