প্রতীকী ছবি।
সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনায় গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি ১৪ থেকে ২০ বছরের ছেলেমেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা আমাদের দেশে এবং রাজ্যে বেড়েই চলেছে। বর্তমান সময়ে এই ভয়ঙ্কর অবস্থার কারণে বিভ্রান্ত আমাদের সমাজ। কেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে এত উগ্রতা, কেন তারা বাড়ির পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছে না, বিদ্যালয়ে বা মহাবিদ্যালয়েও তারা অসহিষ্ণু কেন, এর জন্য শুধু কি তারাই দায়ী, নাকি বর্তমান সমাজ, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কিছু আইন প্রণয়ন এবং বিশ্বায়নও দায়ী? দায়ী যে বা যাঁরাই হোক, আমরা যে এক চরম সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তা সকলেই অনুভব করতে পারছি।
এখনকার অনেক বাবা-মা সন্তানের সামনেই বলেন, ‘আমার একমাত্র সন্তান। তাকে বকলে, শাসন করলে তার আত্মমর্যাদায় আঘাত করা হবে।’ তাই সন্তানের ভুল কাজকেও অনেক সময় প্রশ্রয় দিতে বাধ্য হন তাঁরা। ফলে সন্তানের ভুল বাড়ি থেকেই শুরু হয়। তার জেদ বাড়তে থাকে। সে অবুঝের মতো বাবা-মায়ের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে আবদার করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। এই জেদ, উগ্রতা বাড়ির বাইরে, পাড়ায়, বিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়েও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। যখনই তার কোনও চাহিদা বাধাপ্রাপ্ত হয় তখনই সেটা তার আবেগকে আঘাত করে। সে ভাবে, তার মর্যাদাহানি হচ্ছে। ফলে সে আবেগের কাছে পরাজিত হয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হয় না।
এই প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ের কিছু আচরণ দেখে চমকে উঠতে হয়। গুরুজনদের শ্রদ্ধা না করা, মূল্যবোধ না থাকা, মানুষকে অহেতুক কটূক্তি করে নিজেকে ‘হিরো’ ভাবা, সহানুভূতিশীল মনোভাব না থাকা, মননে-চিন্তনে সবসময় ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা নিয়ে চলছে তাদের অনেকেই।
আমাদের শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে একান্নবর্তী পরিবারে। যেখানে আমরা ভাইবোনেরা ভাগ করে খেতে শিখেছি। একই হ্যারিকেনের আলোয় একসঙ্গে পড়তে শিখেছি। অন্যায় করলে পরিবার ও পাড়ার যে কেউ শাসন করতে পারতেন। সেই কথা বাড়িতে বললে উল্টে আরও দু-চার ঘা খেতে হত মায়ের কাছে। বর্তমানে যা একেবারেই উল্টো। অন্যায় দেখলে কেউ শাসন করলে বাবা-মা সন্তানের সামনেই সেই শাসনকারীকে তাঁর অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বোঝেন না, তাঁর সন্তান অন্যায় করেও প্রশ্রয় পেয়ে গেল।
বিদ্যালয়ে আগে শাসন ছিল। হয়তো তাতে দু’-এক জায়গায় অঘটন ঘটেছে। কিন্তু এখন কী হচ্ছে? প্রত্যেক বিদ্যালয়ে ছাত্রদের শাস্তি দেওয়া বা মনে আঘাত লাগবে এ রকম কোনও কথা বলা আইনত দণ্ডনীয়। সেই নির্দেশও বিদ্যালয়ে টাঙিয়ে রাখতে হয়। আমি নিজেও এই কঠোর শাসনের বিরোধী। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ছাত্রাবস্থায় প্রায় সবার মধ্যেই একটু অন্যায় করা, ভুল জিনিসকে গ্রহণ করা, মিথ্যা কথা বলে নিজেকে বাঁচানো, পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়ার প্রবণতা থাকে। শিক্ষকেরা যদি সেই ভুল শুধরে না দেন শাসনের মাধ্যমে, তা হলে সেই ছাত্র বা ছাত্রী ভুল পথেই এগোবে। অর্থাৎ পরোক্ষ ভাবে আমরা আইনের চক্করে পড়ে সেই সব পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছি।
এ ছাড়াও বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের দেশে অনেক সম্পদ অকালে ঝরে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের সন্তানের উপর অত্যধিক প্রত্যাশা, সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে না পেরে অন্য বন্ধুর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে বহু কিশোর-কিশোরী মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করে। ফলে শেষ পরিণতি হিসেবে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে আরও বিভিন্ন কারণে কিশোর-কিশোরীরা মানসিক অবসাদে ভুগছে এবং আত্মহননের পথে ঝুঁকছে। যেমন, বন্ধুদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক সচ্ছল বন্ধুর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়া। চাকুরিরত বাবা-মায়ের সান্নিধ্য কম পেয়েও অনেক সময় সন্তান অবসাদে ভুগতে থাকে। বাবা-মা বুঝতেই পারেন না যে, এক জন শিশুর শৈশব থেকে কৈশোরের মধ্যে কতখানি জায়গা জুড়ে তাঁরা থাকেন। ফলে বাবা-মায়ের কাছ থেকে সে ভাবে সময় না পেয়ে কিশোর বয়সে সন্তানের মধ্যে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। ফলে তাকেও একাকিত্ব গ্রাস করে।
অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোনও মানসিক অবসাদ এবং পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়ার অন্যতম কারণ। বর্তমানে অনেক সংসারেই এই যন্ত্রটি একটি চরম অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ থেকে দশ বছর আগেও এই সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি বাবা-মা, শিক্ষক শিক্ষিকাদের। ফলে সেই সময় মানসিক অবসাদের লক্ষণও ছেলেমেয়েদের অনেক কম ছিল। বর্তমানে ছেলেমেয়েদের মধ্যে মানসিক দৃঢ়তাও কম বলে আমার মনে হয়। কোনও কারণে সে ব্যর্থ হলে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে এবং সামাজিক লজ্জা থেকে নিজেকে বাঁচাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এই দুর্বল চিত্তের কিশোর-কিশোরীরা তার বিফলতাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেখায় না। বর্তমানে নানা সামাজিক অস্থিরতার কারণে দিশাহীন হয়ে পড়ছে বহু ছাত্র-ছাত্রী। ফলে তারা কোনও লক্ষকে স্থির করে এগোতে পারছে না এবং এক চরম হতাশা তাদের গ্রাস করছে। (চলবে)
প্রধান শিক্ষক,
গোরাবাজার আইসিআই