ফাইল চিত্র।
দেশব্যাপী পরিযায়ী শ্রমিকদের রোজগার প্রকল্প বাবদ কেন্দ্রের বরাদ্দ পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার এক কানাকড়িও বাংলার ভাগ্যে জুটিল না। প্রকল্পের আওতায় দেশের যে ছয়টি রাজ্যের ১১৬টি জেলাকে চিহ্নিত করা হইয়াছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয় নাই। প্রসঙ্গত, এই রাজ্যে করোনার প্রকোপ কোনও অংশে কম নহে। ভিন্ রাজ্যে কর্মসন্ধানে যাওয়া কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক নিজভূমি বঙ্গে ফিরিয়া আসিয়াছেনও বটে। তথাপি পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলাও এই তালিকায় না থাকা আশ্চর্য বইকি। কোভিড-১৯’ সঙ্কটের প্রথম পর্ব হইতেই পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে যে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার কোপ লাগিয়া আছে, স্পষ্টতই ইহা তাহাতে শেষতম সংযোজন। মুখ্যমন্ত্রী বারংবার রাজ্যের প্রাপ্য অর্থের অন্তত কিয়দংশ চাহিয়াছেন, কিন্তু পুরাতন প্রাপ্য কিংবা নূতন বরাদ্দ, কোনওটিরই সাক্ষাৎ মিলে নাই, এমনকি ঐতিহাসিক আমপান দুর্যোগের পরেও নহে। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে একাধিক বার রাজ্যের এই চরম দুর্ভাগ্যের কথা আলোচিত হইয়াছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের রোজগার প্রকল্প সূত্রে সেই একই বঞ্চনা ও অবহেলায় আবারও ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়া গত্যন্তর নাই। প্রাক্-নির্বাচনী আবহে সম্ভবত এই বিরোধমূলক কার্যক্রম এবং তৎসঞ্জাত দুর্ভাগ্য হইতে রেহাই মিলিবে না।
সঙ্গে অবশ্য আর একটি কথাও না বলিলেই নহে। বিরুদ্ধভাবাপন্ন কেন্দ্রের বঞ্চনার পাশাপাশি বর্তমান রাজ্য সরকারের মানসিকতাতেও কি রাজ্যের সঙ্কট বাড়ে নাই? ‘গরিব কল্যাণ রোজগার অভিযান’ নামক ওই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের মাধ্যমে নথিভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকেরা আগামী চার মাসে উন্নয়নমূলক বিবিধ কাজে নিযুক্ত হইয়া রোজগার করিতে পারিবেন। তবে এই ক্ষেত্রে প্রকল্পের সুযোগ গ্রহণের জন্য কোনও একটি জেলায় অন্তত পঁচিশ হাজার শ্রমিকের প্রত্যাবর্তনের তথ্য রাজ্যের তরফে কেন্দ্রের কাছে দাখিল করা বাধ্যতামূলক। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাহা করে নাই। অথচ ইহা কোনও কঠিন অঙ্ক ছিল না। রাজ্যের কোন জেলায় কত সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক পৌঁছিলেন, সেই হিসাব করিতে রকেট-বিজ্ঞান লাগে না। সকল জেলা প্রশাসন নিজ দায়িত্বে এই হিসাব রাখিবেন, ইহাই অভিপ্রেত। কিন্তু বাদ সাধিল উচ্চ প্রশাসনের অসহযোগিতার মনোভাব। দেশের ছয়টি রাজ্যের ১১৬টি জেলায় প্রত্যাগত পরিযায়ী শ্রমিকেরা আপাতত অন্নসংস্থানের যে সুবিধাটুকু পাইলেন, পশ্চিমবঙ্গে তাহা কার্যত প্রত্যাখ্যাত হইল। লাভ হইল কাহার? বাংলায় পাঁচ-সাত লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ফিরিবার হিসাব শোনা যায়। তাঁহাদের একাংশও যদি কেন্দ্রের আলোচ্য রোজগার প্রকল্পটির সুবিধা পাইতেন, রাজ্যের আর্থিক ভার অবশ্যই কিছুটা লাঘব হইত।
রাজ্যের এই অসহযোগের পিছনে একাধিক কারণ থাকিতে পারে। একটি সম্ভাব্য কারণ, পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা দেখাইলে প্রমাণিত হয়, রাজ্য হইতে কত বেশি লোক কর্মসন্ধানে ভিন্ রাজ্যে চলিয়া গিয়াছেন। নির্বাচন শিয়রে লইয়া তাহা মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে স্বস্তিকর হইতে পারে না। আর, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের না থাকিবার ঘটনা এই প্রথম বারও নহে। ‘প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি’ এবং ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পের কথা স্মরণ করা যায়। হয়তো রাজ্যে নরেন্দ্র মোদীর নামাঙ্কিত জনকল্যাণমূলক প্রকল্পেই মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি ছিল। ফলত আয়ুষ্মান প্রকল্পে কেন্দ্রের ষাট শতাংশ ও রাজ্যের চল্লিশ শতাংশ ভাগ ভুলিয়া রাজ্যকে নিজ প্রকল্পের পুরা ব্যয়ভার বহন করিতে হয়। বাংলার কৃষক পরিবারগুলিকে বার্ষিক সাহায্যও রাজ্যই দেয়। রাজ্যের চরম অর্থসঙ্কটের মধ্যে এই সব সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা লইয়া প্রশ্নের অবকাশ রহিয়াছে। দুই রাজনীতির দড়ি টানাটানিতে রাজ্যের স্বার্থ কতখানি রক্ষিত হইতেছে, সে বিষয়েও প্রশ্ন থাকিতেছে।