বাংলা ভাষায় রিপাবলিক অর্থে প্রজাতন্ত্র শব্দটি বহুলপ্রচলিত। কালক্রমে টের পাওয়া গিয়াছে, প্রতিশব্দ হিসাবে তাহা রীতিমতো সমস্যাসঙ্কুল। রিপাবলিক যদি নাগরিকদের আত্মশাসনের কাঠামো হয়, তবে তাহার বাংলা করিবার সময় ‘প্রজা’কে তফাতে রাখাই বিধেয় ছিল। কিন্তু, রাজনীতির রাজ-টিকার মতোই, রিপাবলিক হইতে প্রজাকেও বিসর্জন দেওয়া যায় নাই। সাধারণতন্ত্র বা লোকতন্ত্রের ন্যায় নানা বিকল্প থাকিলেও প্রজাতন্ত্রই বহাল হইয়াছে। শব্দ ব্রহ্ম হউক বা না হউক, তাহার সহিত ব্রহ্মদৈত্যের বিশেষ সাদৃশ্য আছে— ভাষার বৃক্ষে কোনও শব্দ এক বার জমিয়া বসিলে হাজার সমস্যা সত্ত্বেও তাহাকে নড়ানো কঠিন। তবে কিনা, বাস্তব সতত দ্বন্দ্বময়। প্রজাতন্ত্র নামটিকে অন্য ভাবে পড়িবারও যুক্তি আছে বইকি। সেই যুক্তি বলিবে: বরাবর যাহাকে ক্ষমতাহীন প্রজা করিয়া রাখা হইয়াছিল, সে-ই যে আজ ক্ষমতার উৎসে অধিষ্ঠিত— প্রজাতন্ত্র শব্দটি এই সত্যকে প্রতিনিয়ত মনে করাইয়া দিতে পারে। অর্থাৎ, এই শব্দ নিরন্তর তাহার শরীরে আপনাকে অতিক্রম করিবার প্রতিস্পর্ধাকে ধারণ করিয়া চলিবে, এইখানেই তাহার বিশেষ উপযোগিতা।
এই প্রতিস্পর্ধা কত গুরুত্বপূর্ণ, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি তাহার প্রমাণ। যাঁহারা এই দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রটি চালনা করিতেছেন, তাঁহাদের কথায় ও কাজে নাগরিকদের প্রজা বলিয়া গণ্য করিবার মানসিকতা অতিমাত্রায় প্রকট। তাঁহারা মনে করেন, নির্বাচনে জয়ী হইবার পরে নাগরিকের মতামত শুনিবার আর কোনও দায় তাঁহাদের নাই, যে কোনও বিষয়ে তাঁহারা যে কোনও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিবেন এবং দেশবাসীকে তাহা বিনা প্রশ্নে মানিতে হইবে। কেহ প্রশ্ন তুলিলেই তিনি দেশদ্রোহী বলিয়া গণ্য হইবেন। অর্থাৎ, নাগরিকরা কেবল প্রজা নহেন, অনুগত প্রজা। এই ব্যাধি শূন্য হইতে সহসা আসিয়া পড়ে নাই। স্বাধীন ভারতের সাত দশকের জীবনে বারংবার রাষ্ট্র এবং দেশের সীমারেখা লঙ্ঘনের আশঙ্কা দেখা দিয়াছে, প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রকরণটিকে কাজে লাগাইয়া শাসকরা অনেক সময়েই সর্বশক্তিমান হইয়া বসিতে চাহিয়াছেন, সাময়িক ভাবে গণতন্ত্রের ব্যবস্থাটিকে বিসর্জন দিতেও পিছপা হন নাই। কিন্তু বর্তমান জমানার বিপদটি ভিন্ন চরিত্রের। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের মূলে আঘাত করিয়া এক অন্য ভারত গঠনের তৎপরতা ক্রমশই জোরদার হইতেছে, যে ভারতে গণতন্ত্রের অর্থ সংখ্যাগুরুবাদ, শাসনের অন্য নাম আধিপত্য, এবং নাগরিকের প্রতিশব্দ— প্রজা। সর্বাধিক উদ্বেগের কারণ ইহাই যে, বহু নাগরিক প্রজার ভূমিকা পাইয়া আহ্লাদে বিগলিত, ভক্তিরসের প্লাবনে গণতান্ত্রিক অধিকারের চেতনা বেবাক ভাসিয়া গিয়াছে। প্রশ্নহীন আনুগত্যের পাঁকে ডুবিতেছে প্রজাতন্ত্রের মূল ধর্ম।
এই উদ্বেগের মেঘরাশি ছিন্ন করিয়া যখন প্রতিস্পর্ধার আলো উদ্ভাসিত হয়, তখন নাগরিক মনে ভরসা জাগে। উত্তরণের ভরসা। এক বৎসর আগে জেএনইউ বা জামিয়া মিলিয়ার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইতে শাহিন বাগ অবধি সেই ভরসার জাগরণ ঘটিয়াছিল, তাহার আলোকরেখা সঞ্চারিত হইয়াছিল দেশের নানা প্রান্তে, এই কলিকাতা শহরেও, রাষ্ট্রের অন্যায় দাপটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীরা সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করিয়া লোকতন্ত্রের দাবি ঘোষণা করিয়াছিলেন। এই বছর সেই দাবিই অন্য পরিসরে ঘোষিত হইতেছে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদীদের অভূতপূর্ব আন্দোলনে। এই মহিমময় দিনটিতে রাজধানীর রাজপথে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সার্বভৌমত্বের সামরিক শক্তি প্রদর্শনীর বার্ষিক আচারের সমান্তরাল ভাবে এ-বার কৃষকদের যে ট্রাক্টর-সমৃদ্ধ মহামিছিলের আয়োজন, তাহা এক অনন্য প্রতীক হইয়া উঠিয়াছে। প্রজাতন্ত্রের প্রতীক। প্রজার আপন ভাগ্য জয় করিবার অধিকারই সেই তন্ত্রের চালিকা শক্তি। এবং তাহার পরম লক্ষ্য।